কোভিড-১৯ এর বাজারে নতুন আতঙ্ক ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’। ইদানীংকালে ভারতে এই ফাঙ্গাসের সংক্রমণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দিল্লী এবং মহারাষ্ট্রে কোভিড-১৯ থেকে সেরে উঠছেন এমন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী ফাঙ্গাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন। রোগীদের অনেকেই এই সংক্রমণের কারণে চোখ হারিয়েছেন। কারও ক্ষেত্রে চোয়ালের হাড় অপসারণ করতে হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস আক্রান্তদের মৃত্যুহার শতকরা ৫০ শতাংশ।
আমাদের দেশেও যেহেতু ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ভাইরাস পাওয়া গেছে, অনেকেই তাই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নিয়ে আতঙ্কিত। যদিও ভ্যারিয়েন্টের সাথে ফাঙ্গাসের 'প্রত্যক্ষ' সম্পর্ক নেই। এই ফাঙ্গাস একটি ভয়ঙ্কর বিষয় বটে। কিন্তু আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নয়। সব কোভিড-১৯ রোগীই যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হবেন এমন না। এবং আরেকটি ভালো জিনিস হচ্ছে ফাঙ্গাসটি ছোঁয়াচে নয়। এটি মানুষে-মানুষে বা প্রাণী থেকে মানুষে ছড়ায় এমন কোন জীবাণুঘটিত বিষয় নয়। সঠিক তথ্য় ও জ্ঞানই এই সমস্যার বিরুদ্ধে আমাদের প্রধান হাতিয়ার। ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের বিষয়ে এই পর্যন্ত পাওয়া সমস্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখে নেয়া যাক - এটি কি, কাদের হয়, কিভাবে একে প্রতিরোধ করা যায় এবং কেউ যদি একান্তই আক্রান্ত হয়ে যান তাহলে কি চিকিৎসা দেয়া হবে।
আরও পড়ুন : করোনা আক্রান্ত ফুসফুসের স্বাস্থ্য পুরুদ্ধারের উপায়
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কি?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস একটি ছত্রাক ঘটিত রোগ। ডাক্তাররা বলেন “ মিউকরমাইকোসিস”। আগে নাম ছিল জাইগোমাইকেোসিস। এই ছত্রাকের সংক্রমণ অত্যন্ত গুরুতর রূপ নেয়। কিন্তু একই সাথে সংক্রমণটি অত্যান্ত বিরলও। যে মোল্ড বা ছত্রাক দিয়ে সংক্রমণটি হয়, তাদের নাম মিউকরমাইকোসাইট। এই ছত্রাকগুলো পরিবেশে বসবাস করে। মূলতঃ যাদের আগে থেকেই কোন স্বাস্থ্য সমস্যা আছে, বা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এমন কোন ঔষধ যারা নিয়মিত গ্রহণ করছেন তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি হতে পারে। মলূতঃ আমাদের নাকের দুই পাশের সাইনাস, এবং ফুসফুস আক্রান্ত হয় এই ফাঙ্গাসের মাধ্যমে। পরিবেশ থেকে শ্বাসের মাধ্যমে ফাংগাসের স্পোর গ্রহণ করার পর এই ঘটনাটা ঘটে। তবে শরীরে কেটে গেলে, পুড়ে গেলে,বা ত্বকের অন্য কোন আঘাতের পর সেখানেও সংক্রমণ হতে পারে এই ছত্রাকের।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে করণীয় :
ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী পাওয়া যাওয়ার পর দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে সংক্রমণের বিরুদ্ধে একটি গাইডলাইন দেয়া হয়। এই গাইডলাইনের প্রস্তুতকারক ইউনিয়ন হেলথ মিনিস্ট্রি এবং আই-সি-এম-আর। ভারতের করোনা ভাইরাস মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধে এই দুটো সংস্থা ছিল অগ্রসৈনিক।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের উপসর্গ :
- চোখে বা নাকের আশেপাশে ব্যাথা এবং লাল হয়ে যাওয়া ।
- মাথাব্য়াথা সহ জ্বর
- কাশি
- শ্বাসকষ্ট
- রক্তবমি
- রোগীর মানসিক অবস্থার লক্ষণীয় পরিবর্তন
কারা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের ঝুঁকিতে রয়েছেন:
- যাদের অনিয়ন্ত্রিত ডায়েবেটিস মেলাইটাস
- স্টেরয়েডর ব্যবহার যাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে রেখেছে
- দীর্ঘদিন আইসিইউতে ছিলেন এমন রোগী
- যাদের আরও কোন মুমূর্ষতা রয়েছে - যেমন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর বা ক্যান্সার
- যারা ভরিকোনাজোল থেরাপী পাচ্ছেন। ভরিকোনাজোল এস্পার্জিলোসিস নামক ফাংগাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বেশীদিন ব্যবহার করলে জাইগোমাইকোসিস হয় এমন দেখা গেছে।
কোভিড-১৯ রোগীরা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস প্রতিরোধে যা করবেন :
- হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে অতিরিক্ত সুগারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
- কোভিড-১৯ এর রোগীকে হাসপাতালে থেকে ছুটি দেয়ার পর নিয়মিত তার রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করতে হবে। যাদের ডায়েবেটিস আছে তাদের তো করতেই হবে।
- স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনা - সঠিক সময় ধরে সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে স্টেরয়েড। ইচ্ছে খুশি মত চালিয়ে গেলে হবে না।
- পরিষ্কার, বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে হবে অক্সিজেন যন্ত্রের হিউমিডিফায়ারে
- অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিফাঙ্গালের যথেচ্ছ আন্দাজে ব্যবহার বর্জন করতে হবে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস থেকে বাঁচার জন্য এই কাজগুলি করবেন না :
- ফাঙ্গাস সংক্রমণের প্রাথমিক সতর্কতামূলক লক্ষণ ও উপসর্গগুলোকে খেয়াল করতে হবে
- নাক বন্ধের অভিযোগ করছেন এমন সব রোগীকে পরীক্ষা না করেই ব্যাকটেরিয়া সাইনুসাইটিসের রোগী ভাবা যাবে না। বিশেষ করে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল বা কোভিড-১৯ জনিত কারণে যারা স্টেরয়েড ও অন্য ইমিউন সিস্টেম দমনকারী ঔষধের ব্যবহার করছেন।
- প্রয়োজনে , পটাশিয়াম হাইড্রক্সাইড স্টেনিং, কালচার, ইত্যাদি পরীক্ষা করুন ফাঙ্গাস সমন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
- মিউকরমাইকোসিসের চিকিৎসা যত দ্রুত শুরু করা যায় ততই ভালো। অযথা মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস : ভারতের চিত্র ( বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম অনুসারে)
ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ নিয়ে উৎকন্ঠা বিরাজ করছে। দেখা যাচ্ছে, সংক্রমণটি দেরীতে ধরা পড়লে মৃত্যুর হার পঞ্চাশ ভাগ। অর্থাৎ, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস শনাক্ত হওয়া অর্ধেক রোগীই মারা যাচ্ছেন।
কোভিড-১৯ থেকে সেরে উঠছেন এরকম ২০০ রোগীর মাঝে অন্তত আটজন মিউকরমাইকোসিসের কারণে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গিয়েছেন মহারাষ্ট্রে। একই সময়ে দিল্লী আর গুজরাটেও বিপুল পরিমাণ সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
সুরাট ভিত্তিক কিরান সুপার মাল্টি স্পেশালিটি হাসপাতালের চেয়ারম্যান মাথুর সাভানি জানিয়েছেন, তার হাসপাতালে কমপক্ষে ৫০জন মিউকরমাইকোসিসের রোগীকে তিনি চিকিৎসা দিয়েছেন। আরও ৬০জন মত অপেক্ষায় রয়েছে চিকিৎসার। এর মধ্যে সাতজন রোগী নিজেদের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি ব্রিফিঙের সময়, নিতি আয়োগ মেম্বার ( স্বাস্থ্য) ভিকে পওল বলেন যে, কোভিড-১৯ এর রোগীদের মাঝে তারা মিউকরমাইকোসিসের বেশ কিছু কেস দেখতে পেয়েছেন। “ মূলতঃ ডায়াবেটিস রোগীদের মাঝেই বেশী দেখা যাচ্ছে এই ফাঙ্গাসের সংক্রমণ। যারা নন-ডায়াবেটিক তাদের মধ্যে এই সংক্রমণের ঘটনা তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত এই সংক্রমণ কোন প্রাদুর্ভাবে পরিণত হয়নি , তবে আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি,” জানান তিনি। আরও বলেন, “একজন সিরিয়াস কোভিড রোগী যখন অক্সিজেন সাপোর্টে থাকেন, তখন নিশ্চিত করা জরুরী যে তার হিউমিডিফায়ার থেকে যেন পানি লিক না করে। এই লিক থেকেই ছত্রাক প্রবেশের সুযোগ পায়।” এছাড়াও তিনি বুঝে শুনে এবং যৌক্তিকভাবে স্টেরয়েড ও অন্যান্য রোগ-প্রতিরোধ-ক্ষমতা-দমনকারী ঔষধ যেমন টোসালিজুমাবের ব্যবহার করতে বলেন কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে।
২০২১ মে মাসের আট তারিখের কথা। শনিবার সকাল। মুম্বাইয়ের প্রতিষ্ঠিত চক্ষু-বিশেষজ্ঞ, ডক্টর অক্ষয় নায়ার, একটি সার্জারীর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রোগীর বয়স পঁচিশ। তিন সপ্তাহ আগে এই রোগী কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়েছিলেন।
রোগী ডায়েবেটিক। অপারেশান থিয়েটারে ইতিমধ্যে একজন নাক, গলা, বিশেষজ্ঞ রোগীকে নিয়ে ব্যাস্ত। নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ সার্জন রোগীর নাক দিয়ে একটি টিউব প্রবেশ করিয়ে দিলেন। বের করে আনতে লাগলেন ছত্রাক আক্রান্ত কোষগুচ্ছ। এই কোষগুচ্ছ বা টিস্যুগুলোর সবটাই মিউকরমাইকোসিস আক্রান্ত।
নাক-কানের সার্জনের কাজ শেষ হওয়ার পরে, ডক্টর নায়ার একটি তিন ঘন্টার প্রক্রিয়ার শেষে রোগীর একটি চোখ অপসারণ করেন।
“ আমি ওর চোখটা কেটে বাদ দিচ্ছি, কারণ আর কোন উপায় ছিল না। নইলে এই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হত না। এই রোগটাই এমন, ” ডক্টর নায়ার বলেন। (বিবিসি)
মিউকরমাইকোসিস খুবই বিরল ধরণের সংক্রমণ। সাধারণতঃ মিউকর মোল্ডের সংস্পর্শে আসলে এই সংক্রমণটি দেখা দেয়। মূলতঃ মাটি, উদ্ভিদ, গোবর, পচে যাচ্ছে এমন ফল বা সবজিতে মিউকর মোল্ড বা ছত্রাকটির উপস্থিতি থাকে। “ এই ছত্রাক প্রকৃতিতে সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। মাটিতে বাতাসে সব জায়গায়। এমনকি বহু সুস্থ মানুষের নাক আর মিউকাসে এই ছত্রাকের কণা উপস্থিত আছে,” ডক্টর নায়ার জানান।
এই ছত্রাক, সাইনাস , মস্তিষ্ক এবং ফুসফুসকে আক্রমন করে। ডায়াবেটিক রোগী বা অত্যন্ত গুরুতর রূপে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন, যেমন ক্যান্সার রোগী বা এইচ-আই-ভি এইডসের রোগীরা তাদের ক্ষেত্রে এই সংক্রমণ দেখা যায়।
মিউকরমাইকোসিসে সামগ্রিক মৃত্যুহার ৫০ শতাংশ। কোভিড-১৯ রোগীদের আগ্রাসী রোগ প্রতিরোধ কোষগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্টেরয়েড ব্যবহার করা হচ্ছে। ডাক্তাররা মনে করছেন, সম্ভবতঃ স্টেরয়েডের যথেচ্ছ ব্যবহারই এই ছত্রাকের বৃদ্ধির উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করে দিচ্ছে রোগীদের দেহে।
কোভিড-১৯ এর রোগীরদের ফুসফুসে প্রদাহ থাকে। তাছাড়া করোনা ভাইরাসকে মোকাবেলা করতে গিয়ে শরীরের ইমিউন সিস্টেম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। এই দুটি সমস্যার সমাধানের জন্য স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়। কিন্তু স্টেরয়েড ইমিউনিটি কমিয়ে দেয়। এবং ডায়াবেটিক বা নন-ডায়াবেটিক দু’ধরণের রোগীরই ব্লাড-সুগারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
ধারণা করা হচ্ছে, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল বা অকার্যকর হওয়ার সুযোগে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগীর শরীরের দখল নিয়ে নিচ্ছে।
“ডায়াবেটিস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। করোনা ভাইরাস শরীরকে আরও দুর্বল করো তোলে। এরপর যখন স্টেরয়েড দেয়া হয় কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য , তখন যেন পেট্রলে অগ্নিসংযোগের মত একটা ঘটনা ঘটে,” বলেন ডক্টর নায়ার।
ডক্টর নায়ার, মুম্বাইয়ের তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার দিয়ে থাকেন রোগীদের। মুম্বাই , বিশ্বে করোনার দ্বীতিয় ঢেউয়ে সবচেয়ে মারাত্নক ভাবে আক্রান্ত হওয়া শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ডক্টর নায়ার জানান যে, তিনি ইতিমধ্যেই এপ্রিলে ৪০ জন রোগীকে ছত্রাকের সংক্রমণে আক্রান্ত হতে দেখেছেন। তাদের অনেকেই ছিলেন ডায়াবেটিক। এরা বাড়িতে থেকেই কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ১১ জনের চক্ষু অপসারণ করতে হয়েছে।
আরও পড়ুন : করোনা প্রতিরোধ করবে যে ছয়টি মসলা
২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি নাগাদ ডক্টর নায়ারের সহকর্মীগণ - মুম্বাই , ব্যঙ্গালোর, হায়াদ্রবাদ, দিল্লী এবং পুনে - এই পাঁচটি শহর থেকে মোট ৫৮ টি সংক্রমণের কেসের কথা জানিয়েছেন। অধিকাংশ রোগীই কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠার ১২ থেকে ১৫ দিন ব্ল্যাঙ্ক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
মুম্বাইয়েরে অত্যান্ত ব্যাস্ত সায়ন হাসপাতালে, ছত্রাকের সংক্রমণের ২৪ টি কেস রিপোর্ট করা হয়েছে, গত দুই মাসে। আগে বছরে ছয়টার বেশী এমন কেস দেখতেন না এখানকার ডাক্তাররা - জানান ডক্টর রেনুকা ব্রাডু। তিনি সায়ন হাসপাতালের নাক -কান -গলা বিশেষজ্ঞ।
এই চব্বিশ জনের মধ্যে এগারজন চোখ হারিয়েছেন। ছয়জন মারা গেছেন। অধিকাংশ রোগীই ছিলেন মধ্যবয়স্ক। কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠার দুই সপ্তাহ পর তারা ভাইরাসের আক্রান্ত হয়েছিলেন। “ এখন প্রতি সপ্তাহেই আমরা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের দুই থেকে তিনটি কেস পাচ্ছি। একে তো মহামারি চলছেই, তার ভেতরে এটি আরেক দুঃস্বপ্নের মত,”তিনি বলেন।
দক্ষিণী শহর বেঙ্গালুরুতে, ডক্টর রাঘুরাজ হেগড়ে, যিনি একজন চক্ষু সার্জন, একই ধরণের খবর দিলেন। গত দুই সপ্তাহে তিনি মিউকরমাইকোসিসের কেস পেয়েছেন ১৯ টি। এদের বেশীরভাগই কম বয়সী রোগী। তিনি বলেন যে, “ এদের কেউ কেউ এত বেশী অসুস্থ ছিলেন যে আমরা তাদের অপারেশনই করতে পারিনি।”
এই ছত্রাক সংক্রমণের তীব্রতা এবং করোনার দ্বীতিয় ঢেউয়ের সময় এত বিপুল পরিমাণে এই ফাঙ্গাসের রোগী পেয়ে ডাক্তারা অত্যান্ত বিস্মিত হচ্ছেন। গত বছর করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় এত বেশী ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের রোগী তারা পাননি।
ডক্টর নায়ার বলেন যে, বিগত দুই বছরে তিনি মুম্বাইয়ে ১০টির বেশী কেস দেখেননি। “ এই বছরের (২০২১) ঘটনাই অন্যরকম,” তিনি বলেন।
বেঙ্গালুরুতে, ডক্টর হেগরে দশ বছরের বেশী চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন। ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের রোগী বড় জোর একটি কি দুটির বেশী তিনি দেখেন নি।
ফাঙ্গাসের সংক্রমণে ভুগছেন এমন রোগীদের সাধারণতঃ নাক বন্ধ থাকে। নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। চোখ ফুলে যায় এবং ব্যাথা করে। চোখের পাতা ঝুলে পড়ে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়, এবং শেষমেষ, দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। নাকের আশেপাশে কাল কাল ছোপ পড়তে পারে।
ডাক্তারা বলেন যে, তাদের অধিকাংশ রোগীই আসেন দেরীতে। ততদিনে তারা দৃষ্টিশক্তি হারাতে শুরু করেছেন। সংক্রমণ যেন মস্তিষ্কে চলে যেতে না পারে সেজন্য তখন সার্জারি করে চোখটি বাদ দিতে হয় ডাক্তারদের।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে, জানাচ্ছেন ভারতীয় ডাক্তাররা, রোগীরা তাদের দুটো চোখেরই দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন। মাঝে মাঝে এরকম রোগীও পাচ্ছেন, যাদের চোয়ালের হাড়টি অপসারণ করতে হয়। যাতে সংক্রমণ আর না ছড়ায়।
একটি এন্টি-ফাঙ্গাল আন্তঃশিরা ইনজেকশানের ডোজপ্রতি মূল্য ৩৫০০ রুপি বা আটচল্লিশ ডলারের মত। বাংলাদেশি টাকায় চার হাজারের মত। এই ইনজেনকশান টানা আট সপ্তাহ মত প্রতিদিন দিতে হয়। ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে এই একটি মাত্র ড্রাগই কার্যকর।
“কোভিড-১৯ এর পরে রোগীদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের সম্ভাবনা কমিয়ে আনার একটি উপায় হচ্ছে - চিকিৎসা পাচ্ছেন এবং সেরে উঠছেন - এমন রোগীদের স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষেত্রে ডোজ এবং সময়কে ঠিক রাখা, মানে অতিরিক্ত ব্যবহার করা যাবে না স্টেরয়েডের,” বলেন ডক্টর রাহুল বক্সি। তিনি মুম্বাই ভিত্তিক একজন ডায়বেটোলজিস্ট।
তিনি বলেন গত এক বছরে তিনি ৮০০ ডায়াবেটিক কোভিড-১৯ রোগীকে চিকিৎসা করেছেন। তাদের কারুরই ছত্রাকের সংক্রমণটি হয়নি। “ রোগীকে ছুটি দেয়ার পরে রোগীর সুগার লেভেলের দিকে খেয়াল রাখা খুবই জরুরী,” জানান ডক্টর বক্সি।
একজন সিনিওর সরকারী কর্মকর্তা বলেন, এখন পর্যন্ত একে প্রাদুর্ভাব বলা যাচ্ছে না। তারপরও এই যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়তই আরো আরো মিউকরমাইকোসিসের রোগীর খবর আমরা পাচ্ছি, সেটি আশঙ্কাজনক বটে। “ যে স্ট্রেইনের ভাইরাস দিয়ে এই রোগীদের কোভিড-১৯ হয়েছ, সেটি অত্যান্ত দুর্ধর্ষ একটি ভাইরাস। রোগীর ব্লাড সুগার লেভেলকে খুব বাড়িয়ে দেয়। আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, অনেক কম বয়সী রোগীরাও এই ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন,” বলেন ডক্টর হেগরে।
এখন পর্যন্ত ডক্টর হেগরে সবচেয়ে কম বয়সী যে রোগীটিকে পেয়েছেন গত মাসে, তার বয়স ২৭। সেই যুবকের ডায়াবেটিসও ছিল না। “ এই ছেলের যখন কোভিড-১৯ এর দ্বীতিয় সপ্তাহ চলছিল তখন তার ওপর আমাদের অপারেশান করতে হয়, এবং একটি চোখ ফেলে দিতে বাধ্য় হই। অত্যান্ত হৃদয়বিদারক ঘটনা।”
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিসের বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ :
শ্বাসের মাধ্যমে ফাংগাসে স্পোর বা জননকণা কখন আপনার শরীরে ঢুকে পড়ছে সেটি খেয়াল রাখা একটু কষ্টকরই বটে। কারণ যেসব ফানজাই দিয়ে মিউকরমাইকোসিস হয়ে থাকে, সেটি আমাদের পরিবেশে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। মিউকরমাইকোসিস প্রতিরোধমূলক কোন টীকা নেই। যেসব মানুষের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস প্রতিরোধের জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো নেয়া যেতে পারে :
পরিবেশ থেকে নিজেকে রক্ষা করুন : এখানে একটা বিষয় বুঝতে হবে যে, যদিও এগুলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বর্ণণা করা হচ্ছে, তারপরও কোন নিশ্চয়তা নেই যে এগুলো মেনে চললেই আপনি সংক্রমণ থেকে বেঁচে থাকবেন।
- যেসব এলাকায় প্রচুর ধূলো, যেমন নির্মাণ সাইট, সেরকম জায়গা এড়িয়ে চলুন। যদি কোন ভাবেই এড়াতে না পারেন, তাহলে অবশ্যই এন-৯৫ মাস্ক ব্যবহার করুন।
- জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে এই ধরণের ভবন এড়িয়ে চলুন। বিভিন্ন ঝড়বৃষ্টি, বন্যার পানি থেকেও সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
- মাটি বা ধূলোর খুব বেশী স্পর্শে আসতে হয় এরকম কাজকর্ম না করাই ভালো। যেমন উঠান বা বাগানের কাজ। যদি একান্তই এড়াতে না পারেন , তাহলে
- বাগানের , উঠানে বা জংলা এলাকায় যাওয়ার সময় জুতো পড়ুন, লম্বা প্যান্ট পড়ুন, লম্বা হাতার জামা পড়ুন।
- মাটি বা গোবর নিয়ে নড়াচাড়া করার সময় দস্তানা ব্যবহার করুন
- ত্বকের সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য, ত্বকের যেকোন ক্ষত সাবান ও পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলুন।
কখন কোভিড-১৯ রোগীর ক্ষেত্রে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণে সন্দেহ করা যেতে পারে ?
- সাইনাসের প্রদাহ। নাক বন্ধ বা জমে থাকে। নাক দিয়ে কালচে বা রক্তে পূর্ণ তরল বেরিয়ে আসা।
- চিকবোন বা গালের হনুতে ব্যাথা। মুখের এক দিকে ব্যাথা, অসাড় ভাব বা ফুলে যাওয়া
- নাকের ওপর কাল কাল ছোপ।
- দাঁতে ব্যাথা, দাঁত আলগা হয়ে আসা, চোয়ালেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া।
- চোখে ঝাপসা দেখা, দুটি করে দেখা। সাথে ব্যাথা। জ্বর। ত্বকে ক্ষত।
- চোখের রক্তনালী রক্তপিন্ডের মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং চোখের টিস্যুতে পচন
- বুকে ব্যাথা, ফুসফুসে পানি জমা, কাশির সাথে রক্ত উঠে আসা, শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন উপসর্গ আরও খারাপ হয়ে ওঠা।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসা :
ভারতের ফোর্টিস হাসপাতালের ডক্টর মোওরিয়া বলেন ,” আন্তঃশিরা ঔষধ দিয়ে এই সংক্রমণের চিকিৎসা করা যায়। বা অনেক ক্ষেত্রে সার্জারীর প্রয়োজন হতে পারে। এই সংক্রমণ থেকে মৃত্যুহার খুবই বেশী। প্রায় তিরিশ থেকে সত্তর শতাংশ।”
কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে এই ছত্রাকের সংক্রমণের চিকিৎসা বিষয়ে, ডক্টর মওরিয়া বলেন , “ অক্সিজেন লেভেল কমে যাচ্ছে এমন কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে কৃত্রিম ভাবে অক্সিজেন দেয়া হয়। এই অক্সিজেন দেয়ার যন্ত্রে একটি হিউমিডিফায়ার থাকে। হিউমিডিফয়ারটির ভেতরে থাকে পানি। এই ধরণের যন্ত্র ব্যবহার করছেন এমন কোভিড-১৯ রোগীদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যান্ত বেশী। আমাদের হাসপাতালে আমরা এই ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকি। আমরা নিশ্চিত করি যে যন্ত্রের কোন লিক নেই। তাছাড়াও রোগীদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারেও খুব খেয়াল রাখতে হবে।”
আরও পড়ুন : অক্সফোর্ডের টিকা বিষয়ক কয়েকটি সাধারণ প্রশ্ন
মিউকোরমাইকোসিসের ব্যবস্থাপনা :
- ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস নিয়ন্ত্রণ করুন
- রোগী যদি এখনও স্টেরয়েড ব্যবহার করতে থাকেন তাহলে সেই স্টেরয়েডের মাত্রা কমিয়ে দিতে হবে। লক্ষ্য থাকবে যত দ্রুত সম্ভব স্টেরয়েডর ব্যবহার বন্ধ করে দেয়া।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দমন করে এমন ড্রাগগুলের ব্যবহার বন্ধ করুন
- প্রয়োজনের সার্জারি করতে হবে। ফাঙ্গাসের সংক্রমণের পঁচে গেছে এমন সমস্ত টিস্যু ফেলে দিতে হবে।
মিউকরমাইকোসিসের মেডিকাল ট্রিটমেন্ট :
- একটি পিআইসিস লাইন বা পেরিফেরালি ইনসার্টেড ক্যাথেটার করতে হবে
- পর্যাপ্ত পরিমাণ তরল যেন রোগীর শরীরে থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে
- অ্যামফোটেরিসিন-বি ইনফিউশান দেয়ার আগে শিরাপথে নর্মাল স্যালাইন দিতে হবে।
- অ্যান্টিফাঙ্গাল থেরাপি দিতে হবে কমপক্ষে ৪-৬ সপ্তাহ
- রোগীকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। রেডিও ইমেজিং ব্যবহার করে দেখতে হবে রোগের অগ্রগতি কেমন।
কোভিড-১৯ এর একজন রোগী কিভাবে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস থেকে বেঁচে থাকতে পারেন, তার একটি মোটামুটি ধারণা আমরা পাচ্ছি। ডায়াবেটিস থাকলে নিয়ন্ত্রণ করুন। স্টেরয়েডের পরিমিত ব্যবহার করুন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সচেতন থাকুন। যেকোন উপসর্গ দেখা দিলেই সাধারণ নাক বন্ধ না ভেবে পরীক্ষা করুন এবং ব্যবস্থা নিন।
আরও যে লেখাগুলি পড়তে পারেন :

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন