ফাঙ্গাস চর্মরোগের একটি সাধারণ কারণ। অনেকেই বিভিন্ন ফাঙ্গাল স্কিন ইনফেকশান বা ফাঙ্গাস ঘটিত চর্মরোগে ভুগে চিকিৎসকের শরাপন্ন হয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনাপূর্বক, চিকিৎসক আপনাকে এন্টিফাঙ্গাল ক্রিম বা মুখে খাওয়ার ঔষধ দিতে পারেন। অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই এসব এন্টিফাঙ্গাল ঔষধের ব্যবহার খুবই ভালো ফলাফল দেয়।
রোগী নিজের ঔষধ ও চিকিৎসা সমন্ধে যত বেশী তথ্যে সমৃদ্ধ থাকবেন, চিকিৎসা পদ্ধতির সামগ্রিকভাবে সফল হওয়ার সম্ভাবনাও ততই বেড়ে যায়। সেই চিন্তা থেকেই, আজকে এন্টিফাঙ্গাল বিভিন্ন ড্রাগগুলোর সাথে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেয়া চেষ্টা করছি। চলুন দেখে নেই, সাধারণতঃ কি কি ঔষধ ব্যবহার হয় ফাঙ্গাসের চিকিৎসায়।
বিভিন্ন ফাঙ্গাস ঘটিত চর্মরোগগুলো সমন্ধে জানতে পড়ুন
কিভাবে বাড়াবেন ত্বকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা? জানতে পড়ুন
অ্যাজোল এন্টিফাঙ্গালসমূহ :
ফাঙ্গাসের একটি কোষ প্রাচীর থাকে। এই প্রাচীর বা ফাঙ্গাসের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান “আর্গোস্টরোল”। অ্যাজোল- ইমিডাজোল আর ট্রায়াজোল এই আর্গোস্টেরোল তৈরী হওয়া বন্ধ করে দেয়। এই ড্রাগগুলো ব্যবহার করলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় অনেক সময়। যেমন: পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, হেপাটাইটিস, এবং ত্বকে ফুসকুড়ি ওঠা।
অ্যাযোল এন্টিফাঙ্গালগুলো সাইটোক্রোম-পিফোর ফিফটি এনজাইমকে দমন করে। এই এনজাইমের বিভিন্ন ড্রাগের বিপাকের জন্য দায়ী। ফলে এই এনজাইমের ওপর নির্ভরশীল এরকম কোন ড্রাগ যদি অ্যাজোল এন্টিফাঙ্গালের সাথে ব্যবহার করেন, তাহলে অন্য ড্রাগটি হয়তো শরীরে ঠিকভাবে কাজ করবে না। ক্ষেত্র বিশেষে অন্য ড্রাগটি থেকে বিষক্রিয়াও হতে পারে।
ইমিডাজোল :
মাইকোনাজোল, ইকোনাজোল, ক্লট্রিমাজোল, কিটোকোনাজোল - এই এন্টিফাঙ্গালগুলো বিষক্রিয়া প্রবণ। তাই শরীরের অভ্যান্তরে এগুলো প্রয়োগ করা হয় না। সাধারণতঃ ওপরিভাগে ক্রিম হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ত্বকের সবচেয়ে বাইরের স্তরে যে ফাঙ্গাল সংক্রমণগুলো হয়, সেগুলির চিকিৎসায় ক্লট্রিমাজোল ব্যবহার করা হয়। ট্রায়াজোলগুলো কিছুটা কম বিষাক্ত। তাই শরীরের অভ্যান্তরে (মুখে, শিরাপথে) সেগুলি ব্যবহার করা যেতে পারে।
ট্রায়াজোল :
বিভিন্ন ইস্ট, যেমন ক্যান্ডিডা এবং ক্রিপটোকক্কাসের প্রজাতিগুলোর বিরুদ্ধে ফ্লুকোনাজোল একটি কার্যকর এন্টিফাঙ্গাল। ফ্লুকোনাজোলোর হাফ লাইফ দীর্ঘ। প্রায় ৩০ ঘন্টার মত। সুতরাং, বেশ অনেকক্ষণ যাবত এই ঔষধটি শরীরে কাজ করতে পারে।
ফ্লুকোনাজোল পানিতে অত্যন্ত দ্রবণীয়। শরীরে প্রতিটি অংশে, কলাতন্ত্রে সে সমান ভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর মধ্যে মস্তিষ্কের চারপাশের সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডও রয়েছে।
ইট্রাকোনাজোল চর্বির সাথে মিশতে পারে। এই এন্টিফাঙ্গালটিও শরীরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর মধ্যে পায়ের নখ, হাতের নখ আছে। সেরেব্রো স্পাইনাল ফ্লুইডে যেতে পারে না সাধারণতঃ। মুখে গ্রহণ করলে ড্রাগটি কতটুকু শোষিত হবে শরীরে সেটি নিশ্চিত বলা যায় না। যেকারণে ড্রাগটি প্রয়োগের পর, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হয় রোগীকে।
ভোরিকোনাজোল মুখে গ্রহণ করলে বেশ ভালোভাবেই শোষণ হয়। তবে রোগী ভেদে কিছু উনিশ বিশ হতে পারে। একারণে ভোরিকোনাজোল প্রয়োগের পরে রোগীকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। মূলতঃ এস্পারজিলোসিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় এই এন্টিফাঙ্গাল।
ভোরিকোনাজোল ব্যবহারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে -
- আলোর প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা
- হেপাটাইটিস
- ক্ষণস্থায়ী রেটিনাল বিষক্রিয়া
পোসোকোনাজোল এবং ইসাভুকোনাজোল হচ্ছে ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যাজোল। অর্থাৎ, অনেক ধরণের ফাঙ্গাসকে এই এন্টিফাঙ্গাল দু’টো মারতে পারে। বিশেষ করে ক্যান্ডিডা প্রজাতি, মিউকোরেশিয়াস মোল্ডস, এবং এস্পারজিলাস প্রজাতির বিরুদ্ধে এটি বেশ কার্যকরী।
এসপারজিলোসিসের চিকিৎসায় ইসাভুকোনাজোল, ভোরিকোনাজোলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। যেসব রোগীর ভোরিকোনাজোলে সমস্যা হবে, তাদের ক্ষেত্রে ইসাভিউকোনাজোল দেয়া যেতে পারে।
একাইনোক্যান্ডিনস :
একাইননোক্যান্ডিন এন্টিফাঙ্গালগুলোর কাজ হল ফাঙ্গাসের কোষ প্রাচীরের “বিটা-১,৩-গ্লুকান” তৈরীকে বন্ধ করে দেয়। তাদের খুব বেশী উল্লেখযোগ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। ক্যাসপোফানজিন, এনিডুলাফানজিন এবং মিকাফানজিন দিয়ে সিস্টেমিক ক্যান্ডিডোসিসের চিকিৎসা করা হয়। ক্যাসপোফানজিন দিয়ে এসাপারজিলোসিসের চিকিৎসাও করা হয়।
পলিইনস :
অ্যামফোটেরিসিন বি ডিঅক্সিকোলেট একটি প্রচলিত এন্টিফাঙ্গাল। এই ড্রাগটিও ফাঙ্গাসের প্রাচীরের আর্গোস্টেরোলের সাথে যুক্ত হয়। এবং ফাঙ্গাসের কোষঝিল্লী নষ্ট করে দেয়। যেসব দেশে সুযোগ আছে, সেখানে অ্যামফোটেরিসি বি ব্যবহার করা হয় না। কারণ ড্রাগটি খুবই কড়া এবং বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
অ্যামফোটেরিসিন-বি এর হাফ-লাইফ অত্যন্ত বেশী। দিনে একবার প্রয়োগ করলেই হয়। সাধারণতঃ সি-এস-এফ’কে অতিক্রম করে না এই ড্রাগ। এই এন্টিফাঙ্গালটির পার্শ প্রতিক্রিয়ার মধ্যে অন্যতম হল - ড্রাগটি ব্যবহারের পরপরই একটি অ্যালার্জির মত হতে পারে। তাছাড়া শিরাপথে ড্রাগটি ব্যবহারের ফলে কিডনীর জটিলতা বা নেফ্রোটক্সিসিটি হতে পারে। এই নেফ্রোটিক্সিসিটি এতটাই গুরুতর যে, ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হবে। অ্যামফোটেরিসিন-বি এর পূর্ণাঙ্গ ডোজ পাওয়া অধিকাংশ রোগীরই ডায়ালাইসিস দরকার হয়। তবে ড্রাগ প্রয়োগের সাথে সাথে, শিরাপথে নর্মাল স্যালাইন চালু রাখলে এই ক্ষতি প্রশমন করা যেতে পারে। ক্রমবর্ধমান অ্যামফোটেরিসিন-বি পেতে থাকলে কিডনীর এমন ক্ষতি হতে পারে যেটিকে আর ঠিক করা সম্ভব হবে না হয়তো।
নিস্ট্যাটিন : নিস্ট্যাটিন ড্রাগটি, অ্যামফোটেরিসিন-বি এর মতই কাজ করে। যেহেতু নিস্ট্যাটিনও খুব কড়া ড্রাগ তাই এটিকে শরীরের বাইরের অংশেই ব্যবহার করা হয়। যেমন : ওরাল বা ভ্যাজাইনাল ক্যান্ডিডিয়াসিস।
অ্যামফোটেরিসিন-বি এর বিপদাপদ সমন্ধে আরও জানুন
অ্যামফোটেরিসিন-বি এর লিপিড ফর্মুলেশান :
অ্যামফোটেরিসিন-বি এর লিপিড ফর্মুলেশান তৈরী করা হয়েছে। অ্যাম-বি ঘটিত বিষক্রিয়া দূর করার জন্য এটির সৃষ্টি। বিভিন্ন স্থানে অ্যাম-বি ডিঅক্সিকোলেটের বদলে এই ড্রাগটি ব্যবহার হয়। এর মধ্যে লাইপোসোম ক্যাপসুলাবদ্ধ অ্যামবি ( লাইপোসোমাল অ্যাম-বি, এল-অ্যামবি)। অথবা ফসফোলিপিডের সাথে মিলিয়ে তৈরী করা কোন জটিল যৌগ ( অ্যামবি লিপিড কমপ্লেক্স, এবিএলসি)।
লিপিড থেকে বিচ্যুত হওয়ার পর ড্রাগটি সক্রিয় হয়ে যায়। অ্যামবি ডিঅক্সিকোলেটের মতই কিছু ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া থাকলেও, সেগুলি কম গুরুতর রূপ নেয়। আগ্রাসী ফাংগাল রোগগুলোতে অ্যামবি’র লিপিড ফর্মুলেশান ব্যবহার হয়। নিউট্রপেনিক ফিভার এবং ভিসেরাল লেশম্যানিয়াসিসের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক চিকিৎসা হিসেবে অ্যাম-বি’র লিপিড ফর্মুলেশান ব্যবহার হয়।
অন্যান্য এন্টিফাঙ্গাল এজেন্টসমূহ :
ফ্লুসাইটোসিন :
ফ্লুসাইটোসিস ( ফাইভ-ফ্লুরোসাইটোসিন)-এর ইস্টের বিরুদ্ধে একটি নির্দিষ্ট ক্রিয়া রয়েছে। একক ভাবে এই এন্টিফাঙ্গালটি ব্যবহার করলে, দ্রুতই রেজিসট্যান্স তৈরী হয়ে যায় শরীরে। সুতরাং, অন্য কোন এন্টিফাঙ্গাল ড্রাগের সাথে একত্রে এটি ব্যবহার করা উচিৎ। ফ্লুসাইটোসিনের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে - মায়েলোসাপ্রেশান (অস্থিমজ্জা থেকে রক্ত কণিকা তৈরীর প্রক্রিয়াকে দমন করা), পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা এবং হেপাটাইটিস।
গ্রিজিওফালভিন :
ডারমাটোফাইটের বিরুদ্ধে গ্রিজিওফালভিন ব্যবহার করা হত। বর্তমানে তার জায়গায় টারবিনাফিন এবং ইট্রাকোনাজোল চলে এসেছে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এখনও গ্রিজিওফালভিন ব্যবহার করা হয়। যেই কোষগুলো কেরাটিন গঠন করে, তাদের ভেতর গিয়ে জমা হয় গ্রিজিওফালভিন। ফলে কোষগুলো পববর্তীতে ফাঙ্গাল আক্রমণের বিরুদ্ধে স্থায়ীভাবে প্রতিরোধী হয়ে যায়।
টারবিনাফিন :
টারবিনাফিন উচ্চমাত্রায় সিবাম এবং ত্বকে ছড়িয়ে পড়ে। এই এন্টিফাঙ্গাল ড্রাগটির হাফলাইফ এক সপ্তাহের বেশী। সাধারণতঃ বিভিন্ন ডার্মাটোফাইট সংক্রমণগুলোর ক্ষেত্রে শরীরের বাইরের অংশে ব্যবহার হয় এই ড্রাগ। মুখে গ্রহণ করা হয় অনাইকোমাইকোসিসের ক্ষেত্রে। টারবিনাফাইনের প্রধান ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া ‘হেপাটিক টক্সিসিটি’। ৫০০০০ জন রোগীর ভেতর একজনের এমন প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যেসব মা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন তাদের টারবিনাফাইন ব্যবহার না করাই ভালো।
যেকোন ঔষধই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করুন। সুস্থ থাকুন। নিজের যত্ন নিন।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন