ইমিউন সিস্টেম (immune system) সবচেয়ে নিকটবর্তী বাংলা ‘রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা’। এটি মানবদেহের একটি গুণ। বহু দিনের বিবর্তন গুণটির বিকাশ ঘটিয়েছে। ইমিউন সিস্টেমের কাজ আপাতদৃষ্টে দু’রকম। প্রথমে বিভিন্ন ধরণের রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে শনাক্ত করে। তারপর ধ্বংস করে। মানবদেহের যথাসম্ভব কম ক্ষতি করে ধ্বংসযজ্ঞটি চালানো হয়।
ইমিউন সিস্টেম (immune system) কি ?
ইমিউন সিস্টেমের(immune system) অস্তিত্ব সমন্ধে উনিশ শতকের আগ পর্যন্ত নিশ্চিত ছিল না মানুষ। যদিও সবসময়ই, সবার মোটামুটি জানা ছিল - একটা সংক্রামক রোগ থেকে একবার সেরে উঠতে পারলে, সেই রোগের বিরুদ্ধে একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা শরীরে তৈরী হয়ে যায়।
বর্তমান সময়ে ইমিউন সিস্টেমের (immune system) আরও কিছু তৎপরতা সমন্ধে আমরা জানতে পারছি। যেমন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, শুধু আমাদেরকে বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে রক্ষাই করে না; আঘাত জনিত কারণে শরীরের টিস্যু বা কলাতন্ত্রের কোন ক্ষতি হলে সেটির মেরামতেও অবদান রাখে।
আবার এই ইমিউন সিস্টেম (immune system) নিয়ন্ত্রিহীন হয় অনেক সময়। তখন বিভিন্ন অটো-ইমিউন ও অটো-ইনফ্লামেটোরী ডিজিজের সৃষ্টি করে। সিস্টেমটিতে কোন গন্ডগোল দেখা দিলে ,মানুষে শরীরের বিভিন্ন ডিজিজ বা অসুস্থতা দেখা দেয়। ইমিউন সিস্টেম ঘটিত এসব ডিজিজে শরীরের প্রতিটি অঙ্গই আক্রান্ত হতে পারে।
এই লেখায় আমরা ইমিউন সিস্টেমের (immune system) গঠন ও কাজ সমন্ধে মৌলিক ধারণাগুলো দেয়ার চেষ্টা করছি। যারা রোগ ব্যাধিকে বুঝতে চান, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও জ্ঞান বাড়াতে চান, ইমিউন সিস্টেমের মৌলিক বিষয়গুলো জানলে ভালোই হয় তাদের জন্য।
ইমিউন সিস্টেমের (immune system)বাহ্যিক গঠন : ইমিউন সিস্টেমের এনাটমি ও ফিজিওলজি
ইমিউন সিস্টেম(immune system) গঠিত হয় , বিভিন্ন লিম্ফয়েড অর্গান ( লসিকা ভিত্তিক অঙ্গ) , কোষ, প্রোটিনের একটি নিবিড় সমন্বয়ে। শরীর জুড়ে ইমিউন সিস্টেমের এই উপাদানগুলো এমন সুকৌশলে স্থাপন করা রয়েছে যে বিভিন্ন সংক্রমণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর সুরক্ষা দিতে পারে।
ইমিউন ডিফেন্স বা রোগ প্রতিরোধের সক্ষমতাকে সাধারণতঃ দুই ভাগে ভাগ করা হয় : ইনেট ইমিউন রেসপন্স ও একুয়ার্ড ইমিউন রেসপন্স
ইনেট ইমিউন রেসপন্স একটি আক্রমণকারী প্যাথোজেনের ( রোগ সৃষ্টিকারী) বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক সুরক্ষা দেয়। অন্যদিকে একুয়ার্ড ইমিউন সিস্টেম তাৎক্ষণিক ভাবে কাজ করে না ; কিছু সময় পরে কাজ করে - কিন্তু যে সুরক্ষা একুয়ার্ড ইমিউনিটির মাধ্যমে পাওয়া যায় সেটি প্যাথোজেনের প্রতি সুনির্দিষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদী।
আরও পড়তে পারেন : কিভাবে বাড়তে পারেন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
ইনেট ইমিউন সিস্টেম
ইনেট ইমিউন সিস্টেমের যে উপাদানগুলো বিভিন্ন সংক্রমণে বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয় : এনাটমিকাল ব্যারিয়ার্স ( যেমন ত্বক), ফ্যাগোসাইটিক সেলস ( যেসব কোষ আক্রমণকারী জীবাণু বা জড়কণাকে ধ্বংস করে) , বিভিন্ন সলিউবাল মলিকুলস ( দ্রবীভূত হতে পারে এরকম অণু) যেমন - কমপ্লিমেন্ট, এবং একিউট ফেজ প্রোটিন ( প্রদাহের প্রতিক্রিয়ায় লিভার থেকে এই প্রোটিন তৈরী হয়)
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কোষ নয় যেগুলি, সেখানে কিছু ‘জেনেরিক মাইক্রোবিয়াল স্ট্রাকচার” থাকে। অর্থাৎ এমন কিছু জৈবিক কাঠামো যেগুলি সাধারণতঃ ঐ জীবাণুতেই বিদ্যমান। ইনেট ইমিউন সিস্টেম এই কাঠামোগুলিক শনাক্ত করতে সক্ষম। শনাক্ত করার মাত্রই তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং জীবাণুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ছুটে যায়। মাত্র কয়েক মিনিটের মাঝে এই ঘটনাটি ঘটে থাকে।
ইনেট ইমিউন সিস্টেমের প্রতিক্রিয়াগুলো বেশীরভাগ মানুষের জন্য একইরকম। এর সাথে লক্ষনীয় পার্থক্য রয়েছে অ্যাডাপটিভ এন্টিবডি আর টি-সেল রেসপন্সের। ব্যাক্তিভেদে এই একুয়ার্ড ইমিউনিটিগুলোর বেশ পার্থক্য হয়।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষ : ফ্যাগোসাইটস (phagocytes)
ইমিউন সিস্টেমের অগ্রসৈনিক ফ্যাগোসাইটস (phagocytes)। ফ্যাগোসাইটস অর্থ, 'খেয়ে ফেলে যেই কোষ'। ফ্যাগোসাইটস বিভিন্ন মাইক্রোঅর্গানিজম বা আণবীক্ষণিক জীবদের গ্রাস করে নেয়। তারপর মেরে ফেলে। ইনফেকশানে নষ্ট হয়ে হওয়া কোষদেহ ( ডেব্রি) খুঁজে বের করে ফ্যাগোসাইটস। এই বর্জ্যকেও সে গ্রাস করে।
ভক্ষণ ছাড়াও অন্য কাজ আছে ফ্যাগোসাইটসের (phagocytes)। এই কোষগুলো বিভিন্ন “ ইনফ্লামেটোরী মলিকুলস” বা প্রদাহ ঘটাতে পারে এরকম অণু তৈরী করে। এই অণুগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ইমিউন সিস্টেমের অন্য ফ্যাগোসাইটদের : নিউট্রোফিল, মনোসাইট আর ম্যাক্রোফেজ। বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাস ঘটিত সংক্রমণ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এসব কোষ।
ফ্যাগোসাইটের গায়ে বেশ কিছু “ রিসেপ্টর” থাকে। এই “ রিসেপ্টর”গুলোকে আঁকশির মত ভাবতে পারেন। রিসেপ্টরের মাধ্যমে জীবাণুর সাথে নিজেকে যুক্ত করে ফ্যাগোসাইট (phagocytes)।
সারফেস রিসেপ্টরগুলো অনেক রকম হয় । এর মধ্যে আছে “ প্যাটার্ণ রিকগনিশান রিসেপ্টর” বা পি আর আর আর। এই রিসেপ্টর, প্যাথোজেন এসোসিয়েটেড মলিকুলার প্যাটার্ণস ( পি এ এম পি এস) নির্ণয় করে আক্রমণকারী জীবাণুতে। অর্থাৎ, একটি জীবাণু বা প্যাথোজেনের আণবিক বিন্যাস কেমন হয় সে সমন্ধে একটা “পূর্বধারণা” আছে ফ্যাগোসাইটের। এটা স্বতঃলব্ধ জ্ঞান। সে না দেখেও জানে কিরকম হয় জীবাণু। সম্ভবতঃ বিবর্তনের ফলাফল। পূর্বধারণার সাথে মিলিয়ে প্যাথোজেনকে শনাক্ত করতে সাহায্য করে এই পি আর আর আর সারফেস রিসেপ্টর।
পি আর আর আর রিসেপ্টরের মধ্যে রয়েছে : -
১। টোল-লাইক রিসেপ্টর
২। নিউক্লিওটাইড অলিগোমারাইজেশান ডোমেইন প্রোটিন লাইক রিসেপ্টর
৩। ম্যানোজ রিসেপ্টর
এরা প্রত্যেকেই প্রোটিন। জীবাণুকে বিভিন্ন উপায়ে তারা শনাক্ত করতে পারে।
যে পি এ এম পি বা জীবাণু সংশ্লিষ্ট আণবিক বিন্যাস রিসেপ্টরগুলো নির্ণয় করে সেগুলি এমন কিছু আণবিক কাঠামো ( মলিকুলার মোটিফ) যা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কোষে উপস্থিত নয়।
পি এ এম পি’র মধ্যে আছে : ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীরের উপাদান, ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ, ভাইরাসের ডাবল স্ট্র্যান্ডেড আরএনএ।
পি আর আর ইমিউন সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফ্যাগোসাইটের (phagocytes) জীবাণু শনাক্ত করার কাজটি এদের ছাড়া সম্ভব না।
ইমিউন সিস্টেমের (immune system) আরও একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান অপসোনিন। ফ্যাগোসাইটের জীবাণুকে গ্রাসকরণ অপসোনিন ঘটিত। একে বলা হয় অপসোনাইজেশান। অপসোনিনের মধ্যে আছে বিভিন্ন একিউট ফেজ প্রোটিন। অর্থাৎ, শরীরের সংকটময় অবস্থায় যেসব প্রোটিন তৈরী করে লিভার। যেমন , সি রিয়েকটিভ প্রোটিন, কম্প্লিমেন্ট এসব অপসোনিন।
অপসোনিনগুলো প্যাথোজেন এনং ফ্যাগোসাইটের রিসেপ্টর - দুটোর সাথেই যুক্ত হয়। একটি সেতুর মত আচরণের মাধ্যমে , ফ্যাগোসাইটোটিস বা জীবাণুর গ্রাসকরণের কাজটিকে আরও সহজ করে তোলে অপসোনিন।
এরপর ফ্যাগোসাইটের অভ্যান্তরে জীবাণুটিকে ধ্বংস করা হয়। জীবাণু গ্রাস করা ও ধ্বংসের ধারাবাহিকতায় একটি সংকেত পাঠায় ফ্যাগোসাইট। ফ্য়াগোসাইটের আহ্বানে সক্রিয় হয়ে ওঠে বিভিন্ন প্রো-ইনফ্লামেটোরী জিন। একে বলে ডাউনস্ট্রিম একটিভেশান। জিনগুলির সক্রিয়তার ফলে উৎপন্ন হয়, বিভিন্ন প্রো-ইনফ্লামেটোরী সাইটোকাইন ( সাইটোকাইন : বিভিন্ন প্রোটিন, পেপটাইড এবং গ্লাইকোপ্রোটিন যেগুলো প্রদাহের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে)।
আরও পড়ুন : গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি খনিজ উপাদান
ইমিউন সিস্টেমের কোষ : নিউট্রোফিল (neutrophil)
ইমিউন সিস্টেমের (immune system) অন্যতম কোষ নিউট্রোফিল (neutrophil)। এই কোষ পলিমরফোনিউক্লিয়ার লিউকোসাইট নামেও পরিচিত।
নিওট্রোফিল (neutrophil) তৈরী হয় বোন-ম্যারো ( অস্থি মজ্জা) থেকে। এরা স্বাধীনভাবে রক্তে বিচরণ করে। এই কোষগুলির জীবনকাল ক্ষুদ্র। একটি নিউট্রোফিলের হাফ লাইফ মাত্র ছয় ঘন্টা। প্রতিদিন সাধারণতঃ টেন টু দি পাওয়ার ইলিভেন বা একশত বিলিয়ান নিউট্রোফিল তৈরী হয়।
নিউট্রোফিল (neutrophil) সাধারণতঃ জীবাণুদের হত্যা করে থাকে। টিস্যুর মাঝে কোষের দ্রুত পরিবহনেও সে সাহায্য করে। এবং জীবাণুর বিরুদ্ধে ইমিউন সিস্টেমের প্রতিক্রিয়া বা ইমিউন রেসপন্সকে শক্তিশালী করে।
নিউট্রোফিলের কাজগুলো এনজাইমের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এনজাইম হল এমন পদার্থ, সাধারণতঃ প্রোটিন, যারা রাসায়নিক বিক্রিয়াকে উস্কে দেয়।
এই এনজাইমগুলো নিউট্রোফিলের(neutrophil) বিভিন্ন গ্র্যানিউল বা কোষকণিকায় ধারণকৃত। গ্রানিউলগুলো কোষের অভ্যান্তরে এমন একটা পরিবেশ বজায় রাখে, যেটা জীবাণু হত্যা ও ধ্বংসে সহায়ক।
গ্র্যানিউল বা কোষকণিকা মূলতঃ দুই রকম : প্রাথমিক বা অ্যাজুরোফিল গ্র্যানিউল। আরেকটি হচ্ছে সেকেন্ডারী বা স্পেসিফিক গ্র্যানিউল। সেকেন্ডারী গ্র্যানিউলের সংখ্যাই বেশী।
প্রাইমারী গ্র্যানিউলে মায়েলো-পার-অক্সিডেজ এবং অন্যান্য এনজাইম থাকে। কোষের ভেতরে গ্রাস করা জীবাণুকে হত্যা ও হজম করে ফেলার জন্য এই এনজাইম।
সেকেন্ডারি গ্র্যানিউল গুলো ছোট। এগুলোর ভেতরে লাইসোজাইম থাকে। আরও থাকে কোলাজেনেজ এবং ল্যাকটোফেরিন। এই তিনটি এনজাইম কোষের বাইরের অংশে নিঃসরণ করা যায়।
কোন ইনফেকশান থাকলে, তার প্রতিক্রিয়ায় এনজাইম তৈরী বেড়ে যায়। মাইক্রোস্কোপির সময় তখন আরও প্রকট গ্র্যানিউল স্ট্যানিং ( গ্র্যানিউলের পরীক্ষাগারের রঙ গ্রহণ। গ্র্যানিউলের সংখ্যাধিক্য হলে, বেশী রঙ গ্রহণ করে গাঢ় দেখায়) পাওয়া যায়। একে বলে “ টক্সিক গ্র্যানুলেশান”।
ক্ষতিগ্রস্থ বা সংক্রমিত কোষে পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন কোষের আশেপাশের এলাকায় বিভিন্ন ইনফ্লামেটোরী মলিকুল ( প্রদাহের অণু) এবং সাইটোকাইন উৎপাদনের সংকেত পাঠায়।
সাইটোকাইনগুলো অস্থিমজ্জায় নিউট্রোফিল (neutrophil) তৈরী ও পূর্ণতা পাওয়াকে তাড়িত করে। সাইটোকাইনের প্রভাবেই এরপর নিউট্রোফিল রক্তপ্রবাহে চলে আসে।
বিভিন্ন কেমোট্যাক্টিক এজেন্ট ( যারা কোষের যাত্রায় সাহায্য করে) এসে নিউট্রোফিলগুলোকে ইনফেকশানের জায়গায় নিয়ে যায়। এরকম এজেন্ট হচ্ছে ইন্টারলিউকিন-৮। তাছাড়া স্থানীয় লসিকা ও রক্তনালীর গাত্র বা এনডোথেলিয়াম সক্রিয় হওয়াও নিউট্রোফিলের (neutrophil) যাত্রাকে (নিউট্রোফিল মাইগ্রেশান) প্রভাবিত করে।
রক্তপ্রবাহে নিউট্রোফিলের যাত্রার কারণেই কোন একটি সংক্রমণের পরপর নিউট্রোফিল কাউন্ট পরীক্ষা করে বেশী পাওয়া যায়।
সংক্রমিত টিস্যুতে নিউট্রোফিল (neutrophil) চলে এসেছে। সক্রিয় নিউট্রোফিল। এবার তারা বিভিন্ন জীবাণুদের খুঁজে খুঁজে বের করে। এবং গ্রাস করে নেয়। গ্রাস করে নেয়া জীবাণুগুলো একটি ঝিল্লী বেষ্টিত আধারে বন্দী হয় কোষের ভেতরে। এই আধার বা ভেসিকেলটির সাথে কোষের সাইটোপ্লাজমিক গ্র্যানিউল যুক্ত হয়। গ্র্যানিউল যুক্ত হওয়ার ফলে একটি ফ্যাগোলাইসোজোম তৈরী হয়। এই সুরক্ষিত প্রকোষ্ঠের ভেতরে হত্যা করা হয় জীবাণুকে।
জীবাণুকে হত্যা করা হয় দু’টি প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে : অক্সিডেটিভ এবং নন-অক্সিডেটিভ হত্যা প্রক্রিয়া।
অক্সিডেটিভ কিলিং হচ্ছে অক্সিজেন নির্ভর হত্যার প্রক্রিয়া। একে রেসপিরেটোরী বার্স্টও বলা হয়। এই প্রক্রিয়াটির সহায়ক : নিকোটিনামাইড এডেনিন ডাইনিউক্লিওটাইড ফসফেট ( এন এ ডি এইচ) - অক্সিডেজ এনজাইম কমপ্লেক্স। এই এনজাইমটি অক্সিজেনকে বিভিন্ন রিএকটিভ অক্সিজেন স্পিসিজ যেমন : হাইড্রোজেন পার অক্সাইড এবং সুপার অক্সাইডে পরিণত করে - এই অক্সাইডগুলো জীবাণুর জন্য মরণঘাতী।
নিউট্রোফিলের (neutrophil) ভেতরকার মায়েলোপারঅক্সিডেজ , হাইপোক্লোরাস এসিড তৈরী করে। এই এসিড একটি শক্তিশালী অক্সিডেন্ট। এবং জীবাণুঘাতী।
নন-অক্সিডেটিভ কিলিং অর্থ , জীবাণু হত্যার যে প্রক্রিয়াটি অক্সিজেনের ওপর নির্ভর করে না। এক্ষেত্রে ফ্যাগোলাইসোজোমের ভেতরে ব্যাকটেরিয়া বিনাশকারী এনজাইম প্রবেশ করানো হয়। প্রতিটি এনজাইমই একাধিক জীবাণু মারতে পারে। যেকারণে অনেকগুলো ব্যাক্টেরিয়া আর ফানজাই’র বিরুদ্ধে সুরক্ষা পাওয়া যায়।
ইমিউন সিস্টেম (immune system) নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণায় নিউট্রোফিলের (neutrophil)
জীবাণু হত্যার আরেকটি পদ্ধতি জানা যায়। ওর নাম নিউট্রোফিল মিডিয়েটেড ট্র্যাপ ফরমেশান। সংক্ষেপে নেট।
সক্রিয় নিউট্রোফিল (neutrophil) থেকে ক্রোমাটিন নিঃসরণ হয়। এর সাথে ইলাস্টেজের মত কোষকণিকা থাকতে পারে। এদের সমন্বয়ে কোষের বাইরে একটি ম্যাট্রিক্স বা জালিকা তৈরী হয়। এই জাল জীবাণুর প্রোটিনগুলোর সাথে আটকে যায়। অর্থাৎ , নিউট্রোফিল রচিত ফাঁদে আটকা পড়ল জীবাণু। এর ফলে জীবাণুটি অচল হয়ে যায়, বা মারা পড়ে। ফ্যাগোসাইটোসিস বা গ্রাস করার প্রয়োজন হয় না।
ফ্যাগোসাইটোসিস এবং নেট তৈরী , এধরণের কাজগুলি নিউট্রোফিলের (neutrophil) গ্লাইকোজেনে সঞ্চয়কে নিঃশেষ করে। পরিণামে মৃত্যু হয় নিউট্রোফিলের।
কোষগুলো মারা যাবার পর, তাদের সমস্ত ধারণকৃত বস্তু বাইরে বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে ধ্বংসাত্নক লাইসোজোমাল এনজাইমগুলো - কোলাজেন বা দেহের গাঠনিক প্রোটিনকে নষ্ট করে। এছাড়াও কোষগুলোর মাঝখানে যে তরলে পূর্ণ জায়গা বা ইন্টারস্টিশিয়াম থাকে, সেখানকার বিভিন্ন উপাদানকে ধবংস করতে থাকে এই এনজাইম। ফলে কাছাকাছি টিস্যুগুলোর লিকুয়েফেকশান ঘটে। অর্থাৎ কাঠামো ভেঙে পড়ার কারণে তার কঠিন থেকে জলীয় অবস্থায় চলে আসে। এভাবে মৃত এবং মরণাপন্ন নিউট্রোফিলরা (neutrophil) জমা হতে হতে তৈরী হয় পাস বা পুঁজ। যদি এই পুঁজ বেশী ছড়িয়ে পড়ে তখন তৈরী হয় অ্যাবসেস।
ইমিউন সিস্টেমের (immune system) কোষ : মনোসাইট এবং ম্যাক্রোফেজ
মনোসাইটস ইমিউন সিস্টেমের (immune system) গুরত্বপূর্ণ কোষ। এরা টিস্যু ম্যাক্রোফেজদের পূর্বরূপ। তারা তৈরী হয় বোন-ম্যারোতে। তারপর রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে। রক্তপ্রবাহে মোট লিউকোসাইটের বা শ্বেতকণিকাদের ৫ পার্সেন্ট মনোসাইট।
রক্তপ্রবাহ থেকে মনোসাইট চলে আসে পেরিফেরাল টিস্যুতে। অর্থাৎ সাধারণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কলাতন্ত্রে। এখানে মনসোইট ম্যাক্রোফেজে পরিণত হয়। দীর্ঘ সময় ম্যাক্রোফেজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে।
বিশেষায়িত টিস্যু ম্যাক্রোফেজদের গুচ্ছ পাওয়া যায় শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। লিভারে একে বলা হয় কাপফার সেলস। ফুসফুসে বলে এলভিওলার ম্যাক্রোফেজ। কিডনীতে থাকে মেসেনজিয়াল সেলস। মস্তিষ্কে থাকে মাইক্রোগ্লিয়াল সেলস।
ইমিউন সিস্টেমের (immune system) আরেকটি কোষ নিউট্রোফিলের মতই, ম্যাক্রোফেজও , জীবাণুকে গ্রাস করে নিজের কোষ দেহের অভ্যান্তরে হত্যা বা ফ্যাগোসাইটোসিস করতে সক্ষম। অন্য প্রক্রিয়াতেও ম্যাক্রোফেজ জীবাণু মারতে পারে।
একই সাথে ইমিউন সিস্টেমের (immune system) প্রতিক্রিয়া বা ইমিউন রেসপন্সকে বিবর্ধন ও নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে ম্যাক্রোফেজ।
টিস্যু পর্যায়ে নজরদারির জন্য এই কোষগুলো গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাক্রোফেজ সবসময়ই খেয়াল রাখে তাদের আশেপাশে কোথাও টিস্যু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কি না, অথবা জীবাণু প্রবেশে কোন লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে কি না।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষ : ডেনড্রাইটিক সেল
ডেনড্রাইটিক সেল অনেকটা ইমিউন সিস্টেমের(immune system) পুলিশের মত। এরা বিশেষায়িত এন্টিজেন-প্রেজেন্টিং সেল। অর্থাৎ , দেহে প্রবেশকারী অনাহূত বস্তুকে ধরে নিয়ে গিয়ে ধ্বংসকারী কোষদের কাছে হাজির করে।
সাধারণতঃ বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শে থাকা বাহ্যিক কলা বা টিস্যুতে এই কোষ উপস্থিত থাকে, - যেমন ত্বকে , এবং মিউকোসাল মেমব্রেমে। রক্তে একটি অপূর্ণাঙ্গ অবস্থায় এই কোষগুলোকে পাওয়া যায়।
ইমিউন সিস্টেমে (immune system) পুলিশরূপ এই কোষগুলো, ফরেইন পার্টিকেল বা দেহের অংশ নয় এমন কণার সন্ধান করে তাদের আশেপাশে পরিবেশে। সক্রিয় হওয়ার পর, মাইক্রোবিয়াল এন্টিজেনগুলোকে স্থানীয় লিম্ফনোডে নিয়ে যায়। এই লসিকাগ্রন্থিতে একুয়ার্ড ইমিউন সিস্টেমের অন্য দুটি কোষ- টি সেল এবং বি সেলের সাথে ডেনড্রাইটিক সেলের মিথস্ক্রিয়া হয়। এর পর, ইমিউন সিস্টেম যে প্রতিক্রিয়া দেয় সেটি রূপ নির্ধারণে ডেনড্রাইটিক সেলের একটি ভূমিকা থাকে।
ইমিউন সিস্টেমের প্রোটিন : সাইটোকাইন
আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সাইটোকাইনের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এই প্রোটিনগুলো প্রদাহের প্রক্রিয়াকে সঞ্চালনা করে। এরা কতগুলো সিগনালিং প্রোটিন ( সংকেত প্রদানে সক্ষম প্রোটিন)। ইমিউন সিস্টেমের (immune system) কোষ ও অন্য ধরণের কোষ থেকেও তৈরী হয় এই প্রোটিন। ১০০রও বেশী রকমের সাইটোকাইন নির্ণয় করা গেছে আমাদের ইমিউন সিস্টেমে।
ইমিউন সিস্টেমের (immune system) প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে সাইটোকাইন। বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধী কোষের মাঝে যোগাযোগ বজায় রাখতেও তারা কাজ করে। এসব ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাগুলি বেশ জটিল।
একটি ইমিউন রেসপন্সের একদম শুরুতে, সাইটোকাইন উৎপাদনের সামান্য তারতম্যও , অন্তিম পরিণতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।
সাইটোকাইনগুলোর বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তু বা টার্গেট সেল রয়েছে। এসব কোষের ওপরকার নির্দিষ্ট রিসেপ্টরের সাথে তারা যুক্ত হয়। ফলে, কোষের আন্তঃকোষীয় সংকেত ব্যবস্থা কার্যকর হয় ( ডাউনস্ট্রিম ইন্ট্রাসেলুলার সিগনালিং পাথওয়েজ)। এর পরিণতিতে জিন ট্রান্সক্রিপশান এবং কোষীয় কার্যক্রমে কিছু পরিবর্তন ঘটে।
ইমিউন সিস্টেমের উল্লেখযোগ্য সাইটোকাইন “ টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টর”।
টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টরের মাধ্যমে নিউক্লিয়ার ফ্যাক্টর কাপ্পা বি ( এন এফ কে বি) পাথওয়ে সক্রিয় হয়। টিএনএফ সুপার ফ্যামিলির অন্য সদস্যরাও এটিকে সক্রিয় করতে পারে। যেমন : রিসেপ্টর এক্টিভেটার অফ নিউক্লিয়ার কাপ্পা বি লিগান্ড। তাছাড়া টোল-লাইক রিসেপ্টর এবং এন-ও-ডি লাইক রিসেপ্টরও একে সক্রিয় করে।
টিএনএফ সুপার-ফ্যামিলির সদস্যদের ক্ষেত্রে বিষয়টি কেমন দেখা যাক। রিসেপ্টর যুক্ত হলে , ইনহিবিটর অফ কাপ্পা বি কাইনেজ ( আই কে কে)-এর তিনটি প্রোটিনের সমন্বয়টি রিসেপ্টরের মাধ্যমে গৃহীত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে টিএনএফ রিসেপ্টর এসোসিয়েটেড প্রোটিনগুলো যুক্ত হয় আই কে কে’র সাথে। আই কে কে সক্রিয় হল। সুতরাং, ইনহিবিটর অফ নিউক্লিয়ার ফ্যাক্টর কাপ্পা বি প্রোটিনের ফসফোরাইলেশান ঘটবে। ফসফোরাইলেশানের ফলে ‘ইনহিবিটর অফ নিউক্লিয়ার ফ্যাক্টর কাপ্পা বি প্রোটিন’ ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে, নিউক্লিয়ার ফ্যাক্টর কাপ্পা বি প্রোটিন স্থান বদল করে নিউক্লিয়াসে চলে যায় এবং জিন ট্রান্সক্রিপশানকে চালু করে।
জ্যানাস কাইনেজ সিগন্যাল ট্রান্সডিউসার এন্ড এক্টিভেটারস অফ ট্রান্সক্রিপশান ( জে এ কে- এস টি এ টি) পাথওয়ের কাজ হল সাইটোকাইন রিসেপ্টরদের সিগনাল ড্রাউনস্ট্রিম করা। জে এ কে -স্ট্যাটের সাহায্য নেয় , ইন্টারলিউকিন-২, ইন্টারলিউকিন-৬ এবং ইন্টারফেরন গামা’র রিসেপ্টর।
( জ্যানাস কাইনেজ সমন্ধে আরও জানুন : জ্যানাস কাইনেজ কি?)
সাইটোকাইন রিসেপ্টরে যুক্ত হওয়ার পরে, জে এ কে প্রোটিনগুলো ফসফোরাইলেটেড হয় অন্তঃকোষীয়ভাবে। ফলে, এস টি এ টি প্রোটিনগুলোও ফসফোরাইলেটেড হয়। এই প্রোটিনগুলো তখন নিউক্লিয়াসে চলে যায়, এবং জিন ট্রান্সক্রিপশানকে সক্রিয় করে। ফলে পাল্টে যায় কোষীয় ক্রিয়া।
ইমিউন সিস্টেমের (immune system) গোলযোগ ঘটিত অসুস্থতার চিকিৎসায় আজকাল নিয়মিতই সাইটোকাইন ইনহিবিটার ব্যবহার করা হয়। যেমন বিভিন্ন অটো-ইমিউন ডিজিজের ক্ষেত্রেও। এই সাইটোকাইন ইনহিবিটরদের বেশীরভাগই সাইটোকাইন বা তাদের রিসেপ্টরগুলোর প্রতি মনোক্লোনাল এন্টিবডি।
এর পাশাপাশি, স্মল-মলিকুল বা অতি ক্ষুদ্র অণু সম্পন্ন ইনহিবিটরও তৈরী করা হয়েছে। এই স্মল-মলিকুল ইনহিবিটরগুলো , আন্তঃকোষীয় সংকেত আদান প্রদানের যে পথ সাইটোকাইন ব্যবহার করে ( ইনট্রাসেলুলার সিগনালিং পাথওয়ে) সেটিকে রুদ্ধ করে দেয়।
স্মল-মলিকুল ইনহিবিটরের মধ্যে আছে : জ্যানাস কাইনেজ ইনহিবিটর , যেমন টোফাসিটিনিব এবং ব্যারাসিটিনিব। রিউমাটয়েড আর্থাইটিসের ক্ষেত্রে এই দুটি ড্রাগ ব্যবহার করা হয়।
টাইরোসিন কাইনেজ ইনহিবিটর আছে : ইমাটিনিব। এটি ব্যবহার হয় ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়ার ক্ষেত্রে।
ইমিউন সিস্টেমের প্রোটিন : ইন্টেগ্রিন
ইন্টেগ্রিনস কোষের ঝিল্লিস্থঃ কিছু প্রোটিন। কোষে-কোষে এবং কোষে ও ম্যাট্রিক্সের আন্তঃক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ইন্টেগ্রিন।
ইন্টেগ্রিনগুলো বহিঃকোষীয় ম্যাট্রিক্সের সাথে কোষের সংযুক্তি, সংকেত তৈরী করে পাঠানো ( সিগনাল ট্রানসডাকশান) এবং সেলের যাত্রা বা মাইগ্রেশানে ভূমিকা রাখে।
অটো-ইমিউন ডিজিজের ক্ষেত্রে ইন্টেগ্রিনের ভূমিকা নিয়ে অনেক গবেষণা করা হয়েছে। রিকম্বিনেন্ট হিউম্যানাইজড এন্টি-আলফা ফোর ইন্টেগ্রিন এন্টিবডি, ন্যাটালিজুমাব, মাল্টিপাল স্কলেরোসিসের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর চিকিৎসা। এই এন্টিবডি , রক্তনালীর দেয়াল ভেদ করে ইমিউন কোষগুলোকে , সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টমে প্রবেশ করতে দেয় না।
ন্যাটালিজুমাব সমন্ধে আরও জানতে পড়ুন
ইমিউন সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ : কমপ্লিমেন্ট
সামগ্রিক ইমিউন সিস্টেমের (immune system) মাঝে কমপ্লিমেন্ট আরেকটি গুরূত্বপূর্ণ সিস্টেম। কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমে একটি প্রোটিনের গ্রুপ কাজ করে। সংখ্যায় বিশটি প্রোটিন। তাদের আবর্তন কঠোর নিয়ন্ত্রিত। এবং কাজের সূত্রে প্রোটিনগুলো পরস্পর সম্পর্কিত। কমপ্লিমেন্ট প্রোটিনগুলোর কাজ হল প্রদাহের অনুকূল পরিবেশ তৈরী করা, এবং আক্রমণকারী প্যাথেজেনদের ধ্বংস করা।
ইমিউন সিস্টেমে (immune system) অনেক অবদান রাখে লিভার। কমপ্লিমেন্ট প্রোটিনগুলোও লিভারে তৈরী হয়। তারপর নিষ্ক্রিয় অবস্থায় তারা রক্তপ্রবাহে অবস্থান করে। কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমটিকে চালু করে দিলেই, পর্যায়ক্রমিক একটি জৈবিক কর্মযজ্ঞ ঘটতে থাকে। পর্যায়ক্রমিক এই প্রক্রিয়া বা ক্যাসকেড দ্রুত শক্তি বৃ্দ্ধি করে। বিষয়টির সাথে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া বা কো-এগুলেশান ক্যাসকেডের সমিল রয়েছে।
ইমিউন সিস্টেমে, কমপ্লিমেন্টের পর্যায়ক্রমিক কর্মকান্ডটি চালু হয় তিনটি কার্যকৌশলের মাধ্যমে :
১। দি এল্টারনেট পাথওয়ে : কমপ্লিমেন্ট প্রোটিন সি-থ্রি ব্যাকটেরিয়াল উপাদানের সংস্পর্শে আসলেই এই পাথওয়ে এক্টিভেট হয়। এগুলো মূলতঃ ব্যাকটেরিয়ার কোষ প্রাচীরের উপাদান । যেমন, গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার লিপোপলিস্যাকারাইড, গ্রাম পজিটিভ ব্যাকরেটিয়ার টেকয়িক এসিড।
২। দি ক্লাসিকাল পাথওয়ে : যখন দুই বা ততোধিক আইজিএম বা আইজিজি অ্যান্টিবডি একটি এন্টিজেনের সাথে যুক্ত হয় তখন কমপ্লিমেন্টে ক্যাসকেড শুরুর এই পাথওয়েটি চালু হয়। অ্যান্টিজেনের সাথে যুক্ত হওয়ার ফলে, অ্যান্টিবডির একটি গঠনগত পরিবর্তন আসে। এর ফলে অ্যান্টিবডির কিছু বাইন্ডিং সাইট বা সংযুক্তির স্থান উন্মোচিত হয়। এই সাইটগুলোর সাথে যুক্ত হয়, ক্লাসিকাল পাথওয়ের প্রথম প্রোটিন সি-ওয়ান।
সি-ওয়ান একটি বহু মাথা বিশিষ্ট অুণ। একই সময়ে ছয়টি অ্যান্টিবডির সাথে সে যুক্ত হতে পারে। অ্যান্টিবডির সাথে সি-ওয়ান অণুর দুই বা ততোধিক মাথা যুক্ত হলে ক্লাসিকাল ক্যাসকেড চালু হয়ে যায়। ক্লাসিকাল পাথওয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইনহিবিটার ( - একটি আগ্রাসী প্রক্রিয়াকে যে নিয়ন্ত্রণে রাখে) হল সি-ওয়ান ইনহিবিটার।
৩। দি লেকটিন পাথওয়ে : জীবাণুর কোষ দেহের ওপরস্থ কার্বোহাইড্রেটের সাথে ম্যানোস বাইন্ডিং লেকটিন সরাসরি যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে দি লেকটিন পাথওয়ে এক্টিভেট হয়।
লেকটিনের সাথে জীবাণুগাত্রের শর্করা যুক্ত হওয়া অনেকটা সি-ওয়ানের সাথে অ্যান্টিজেন-যুক্ত অ্যান্টিবডির সংযোগের মত। ফলে, সরাসরি ক্লাসিকাল পাথওয়েকে স্টিমুলেট করে। ইমিউন কমপ্লেক্স তৈরী হওয়া প্রয়োজন হয় না।
যেকোন একটি পাথওয়ের মাধ্যমে কমপ্লিমেন্ট এক্টিভেট হওয়ার ফলাফল হচ্ছে সি-থ্রী এক্টিভেট হওয়া। সি-থ্রী সক্রিয় হলে সি-ফাইভ থেকে সি-নাইন কমপ্লিমেন্ট প্রোটিনগুলো একসাথে হয়ে মেমব্রেন অ্যাটাক কমপ্লেক্স তৈরী করে।
ইমিউন সিস্টেমে (immune system) এই এম-এ-সি বা জীবাণু কোষের ঝিল্লীটিকে আক্রমণ করতে পারে এমন যৌগ গঠন হওয়া অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এম-এ-সি’র আক্রমণে কোষের দেয়াল ফুটো হয়ে যায়। ফলে লক্ষ্যবস্তু কোষটির অসমোটিক লাইসিস হয়। অর্থাৎ কোষের ঝিল্লীর ছিদ্র দিয়ে ভেতরে তরল উপাদানের ক্ষরণ হতে হতে ধ্বংস হয়ে যায় কোষটি।
কোষ আক্রমণের এই ধাপটির কারণে একাধিক জীবাণুর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারে ইমিউন সিস্টেম (immune system)। বিভিন্ন ক্যাপসুল যুক্ত ব্যাকটেরিয়া যেমন : নিসেরিয়া স্পিশিস, আর হ্যামোফিলিয়াস ইনফ্লুয়েঞ্জাকে এভাবেই মোকাবেলা করা হয়।
ক্যাসকেড চালু হওয়ার পর কমপ্লিমেন্ট প্রোটিনের অনেক ভগ্ন অংশের সৃষ্টি হয়। এই ভগ্ন অংশগুলো অপসোনিন হিসেবে কাজ করতে পারে। অপসোনিন জীবাণকে নিউট্রোফিলকে ও ম্যাক্রোফেজের মাধ্যমে ভক্ষণের আরও উপযোগী করে তোলে। কমপ্লিমেন্টের ভগ্ন অংশগুলো আরও একটি কাজ করে : কেমোট্যাক্সিস। তারা প্রদাগের স্থানে লিউকোসাইটের যাত্রাকে সাহায্য করে।
কমপ্লিমেন্টে ফ্র্যাগমেন্টস বা এই ভগ্নাংশগুলো ইমিউন সিস্টেমে বিশেষ গুরুত্ববাহী। মাস্ট সেলে ( ইমিউন সিস্টেমের কোষ)-র ওপর কমপ্লিমেন্ট রিসেপ্ট। ভগ্নাংশগুলো অ্যানাফিলাটক্সিন হিসেবে কাজ করে এই রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়, এবং হিস্টামিন নিঃসরণ করে। হিস্টামিন নিঃসরণ হলে রক্তনালীর পারমিএবিলিটি ( অর্থাৎ, নালীর দেয়ালের মধ্য দিয়ে তরলের যাওয়া আসার সুবিধা) বেড়ে যায়।
কমপ্লিমেন্ট এক্টিভেশানের বিভিন্ন প্রোডাক্টগুলো এন্টিজেন-প্রেজেন্টিং কোষগুলোকে ইমিউন কমপ্লেক্স চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। এভাবে ইনেট আর একুয়ার্ড ইমিউনিটির মাঝে একটা সম্পর্ক রচনা করে কমপ্লিমেন্টের ভগ্নাংশ।
এক্টিভেটেড কমপ্লিমেন্ট প্রোডাক্টসগুলোর শেষ কাজ হল , ক্যাসকেডের সূচনকারী ইমিউন কমপ্লেক্সটিকে দ্রবীভূত করা। ফলে আশেপাশের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্থ হয় না।
কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমের কেন্দ্রীয় অণু সি-ফাইভ প্রোটিন। এর বিরুদ্ধে একটি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি তৈরী করা হয়েছে - একুলিজুমাব। পার-অক্সিজমাল নকচারনাল হেমোগ্লেবিনিউরিয়া এবং টিপিকাল ইউরেমিক সিনড্রোমের চিকিৎসায় একুলিজুমাব ব্যাবহার করা হয়। দেখা গেছে, সি-ফাইভের বিরুদ্ধ এই অ্যান্টিবডিটি ব্যবহার করলে বিভিন্ন সংক্রমণ হয়ে থাকে, যেমন : মেনিনজোকক্কাল সেপসিস। এর থেকেই বোঝা যায় সংক্রমণ প্রতিরোধে এই কমপ্লিমেন্ট কিরকম গুরুত্বপূর্ণ ইমিউন সিস্টেমে (immune system)।
ইমিউন সিস্টেমের (immune system) কোষ : মাস্ট সেল এবং বেজোফিল
মাস্ট সেল আর বেজোফিল কোষগুলো বোনম্যারো থেকে আসে। বিভিন্ন এলার্জির বিরুদ্ধে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সাধারণতঃ বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শে থাকে যেসব টিস্যু, সেসবেই অবস্থান করে মাস্ট সেল। যেমন, ত্বক আর পাকস্থলী।
অন্যদিক বেজোফিল , প্রান্তীয় প্রবাহ বা পেরিফেরাল ব্লাডে পাওয়া যায়। কোন প্রদাহের ঘটনা ঘটলে তার প্রতিক্রিয়ায় বেজোফিল টিস্যুতে চলে আসে।
দুই ধরণের কোষেই বড় বড় সাইটোপ্লাজমিক গ্র্যানিউলস থাকে। এসব গ্র্যানিউলস বা কোষকণিকার ভেতরে রক্তনালীকে প্রভাবিত করতে সক্ষম, অর্থাৎ ভেসোএকটিভ সাবস্টেন্স থাকে, যেমন : হিস্টামিন।
মাস্ট সেল আর বেজোফিলের কোষদেহে আইজি-ই রিসেপ্টর প্রকাশিত হয়। এরা যুক্ত হয় আইজি-ই অ্যান্টিবডির সাথে।
নির্দিষ্ট এন্টিজেনের সংস্পর্শে আসলে এই কোষ থেকে হিস্টামিন নিঃসরণ হয়। সেই সাথে গ্র্যানিউলের অভ্যান্তরের অন্যান্য মিডিয়েটর ( প্রদাহের প্রভাবক)-ও বাইরে চলে আসে। আবার বাড়তি কিছু মিডিয়েটর সংশ্লেষণ করতে পারে তারা ; যেমন - লিউকোট্রিন, পোস্টাগ্লান্ডিন, সাইটোকাইন।
একটি পর্যায়ক্রমিক প্রদাহ শুরু হয়ে যায়। এটি স্থানীয় রক্তপ্রবাহকে বৃদ্ধি করে। রক্তনালীর পারমিএবিলিটি বাড়িয়ে দেয়। স্মুদ মাসেল বা মসৃণ বেশীর সংকোচন-প্রসারণ বা কন্ট্রাকশান বাড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন মিউকোসাল সারফেস থেকে নিঃসরণ বৃদ্ধি করে।
ইমিউন সিস্টেমের (immune system) কোষ : ন্যাচারাল কিলার সেলস
ইমিউন সিস্টেমের (immune system) অন্যতম সৈনিক ন্যাচারলা কিলার সেল। এরা কতগুলো বৃহদাকার গ্র্যানিউল সমৃদ্ধ লিমফোসাইট ( শ্বেত রক্তকণিকা)। টিউমার এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষায় তারা গুরুত্বপূর্ভ ভূমিকা পালন করে।
অ্যাডাপটিভ এবং ইনেট দু’ধরণের বৈশিষ্ট্যই দেখা যায় এই কোষের। গঠনগত দিক থেকে তারা লিমফোসাইটের মতই। তারাও একইরকম লিগ্যান্ড ( কোষের রিসেপ্টরে যা যুক্ত হতে পারে) শনাক্ত করে থাকে। তবে তারা কোন সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের সাপেক্ষে কাজ করে না, এবং ইমিউনোলজিকাল মেমোরি তৈরী করতে পারে না।
ন্যাচারাল কিলার সেলে অনেক ধরণের সেল সারফেস রিসেপ্টর রয়েছে। এদের কয়েকটি স্টিমুলেটরী, অন্যগুলো ইনহিবিটরী।
ইনহিবিটরি রিসেপ্টরের প্রভাবই প্রধান হয়ে ওঠে। এই রিসেপ্টরগুলো , সাধারণ নিউক্লিয়াস সম্পন্ন কোষে প্রকাশিত “ হিউমেন লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন”কে শনাক্ত করে এবং ন্যাচারাল কিলার সেলের আক্রমণ থেকে সাধারণ কোষকে রক্ষা করে।
অন্যদিকে স্টিমুলেটরি রিসেপ্টরগুলো সেইসব অণুকে শানক্ত করে যেগুলো প্রকাশ পায় প্রধানতঃ সেলের মৃত্যু ঘটলে।
এভাবে, ইমিউন সিস্টেমের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে : ন্যাচারাল কিলার সেল ক্ষতিগ্রস্থ বা সংক্রমিত সেলকে ধ্বংস করে, কিন্তু সুস্থ সেলকে কিছু করে না।
একটি কোষ যখন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, বা ক্যান্সার প্রবণ হয়ে ওঠে, তখন কোষ দেহের প্রকাশিত এইচ-এল-এ ক্লাস ওয়ান অণুর পরিমাণ কমে যায় ( ডাউন রেগুলেটেড হয়)। এটি তাদের একটি কৌশল। এভাবে তারা অ্যাডাপ্টিভ টি লিমফোসাইট রেসপন্সকে এড়িয়ে থাকে। এরকম ক্ষেত্রে ন্যাচারাল কিলার সেলগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ এইচ-এল-এ ক্লাস ওয়ানের পরিমাণ কমে গেলে, ন্যাচারাল কিলার সেল সক্রিয় হয়। ফলাফলে, টি সেল থেকে বেঁচে গেলেও, এন-কে সেলের হাত থেকে রক্ষা পায় না অস্বাভাবিক ও রোগগ্রস্থ কোষটি।
ইমিউন সিস্টেমে (immune system) , ন্যাচারাল কিলার রেল সক্রিয় হওয়ার আরও একটি উপায় আছে। অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডির কমপ্লেক্সের সাথে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমেও ন্যাচারাল কিলার সেল সক্রিয় হতে পারে। এর ফলে এন-কে কোষগুলো এমনভাবে তাদের লক্ষ্যবস্তুর সাথে যুক্ত হয়, যেটা অনেকটা অপসোনাইজেশানের মতই। একে বলা হয় অ্যান্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট সাইটো টক্সিসিটি। এরপর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ন্যাচারাল কিলার সেল তাদের লক্ষ্যবস্তুটিকে ধ্বংস করতে পারে।
সক্রিয় কিলার সেল বিভিন্ন ভাবে তাদের লক্ষ্যবস্তুকে মারতে পারে। তারা এমন কিছু প্রোটিন নিঃসরণ করে যেগুলি কোষের দেহে ছিদ্র তৈরী করতে সক্ষম। যেমন : পারফোরিন। এটি টার্গেট সেলের ঝিল্লীকে ভেদ করে। আবার বিভিন্ন ধরণের প্রোটিন ধ্বংসকারী এনজাইমও তৈরী করতে পারে ন্যাচারাল কিলার সেল। এগুলোকে বলে গ্র্যানজাইম। এই গ্র্যানজাইমগুলো , অ্যাপোপটোসিস ( কোষের মৃত্যু) ঘটায়।
পাশাপাশি, বিভিন্ন ধরণের সাইটোকাইনও তৈরী করে ন্যাচারাল কিলার সেল। যেমন টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টর আলফা, ইন্টাফেরন গামা। এই সাইটোকাইনগুলোর সরাসরি ভাইরাস বিরোধী এবং টিউমার বিরোধী প্রভাব রয়েছে।
শেষকথা :
ইমিউন সিস্টেমের (immune system) প্রধান উপাদান ও ইমিউনোলজির মূল বিষয়গুলো প্রায় এরকমই। ইমিউন সিস্টেম, তথা ইমিউনোলজি বিষয়ক জ্ঞান আয়ত্তে রাখতে পারলে, আপনাকে চিকিৎসকের দেয়া ট্রিটমেন্ট বোঝা আপনার জন্য সহজ হবে। সেই সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সমন্ধেও পরিপূর্ণ একটি ধারণা নির্মাণ করতে পারবেন আপনি।
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
----
অবলম্বন : ডেভিডসন্স মেডিসিন, লেঞ্জ ইমিউনোলজি

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন