সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০

কিভাবে বাড়াবেন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা : ত্বক ও বাহ্যিক রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থাগুলোর যত্ন

  লিখেছেন ডক্টর এম তানভীর হোসেন BDS (DU)

 আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থায় (immune system) বিভিন্ন ফিজিকাল ব্যারিয়ারগুলোর গুরুত্ব খুবই বেশী। দেহকাঠামোর যে অংশগুলো প্রাকৃতিক ভাবেই জীবাণু-নিরোধী গুণ সম্পন্ন তাদের ফিজিকাল ব্যারিয়ার বলে। যেমন ধরুন আমাদের দেহের ত্বক। রোগে প্রতিরোধের এই ভৌত ব্যাবস্থাগুলোর যত্ন নিতে পারলে ছোট বড় অনেক প্রকার অসুখ বিসুখ থেকেই নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।



 

ফিজিকাল ব্যারিয়ার্স বা জীবাণুর বিরুদ্ধে বাহ্যিক প্রতিরোধসমূহ কি কি?

 

ত্বকের গঠন : নিবিড় সন্নিবিষ্ট ‘কেরাটিনাইযড সেল” নিয়ে মানবত্বক গঠিত। এই কেরাটিনাইযড সেলের কারণে ত্বকে কোন একটি জীবাণুর বেঁচে থাকা ও সংখ্যাবৃদ্ধি করা, অর্থাৎ কলোনাইযেশানের, সুযোগটি কম।

ত্বকের তৈলাক্ততা : ত্বকে সিবাশিয়াস গ্লান্ড থাকে। এই গ্ল্যান্ডগুলো থেকে হাইড্রেফোবিক অয়েল বা তেল জাতীয় পদার্থের নিঃসরণ ঘটে। সেই সুবাদেও, পানি এবং জীবাণু  মানবত্বকে টিকে থাকতে পারে না।


 

ত্বকের পরিবেশ : ত্বকের , পি-এইচ কম ( অর্থাৎ অম্লীয় পরিবেশ)। অক্সিজেন টেনশান কম ( অর্থাৎ বেশী অক্সিজেন ধরে রাখতে পারে না)।

ঘাম : ঘামের মাঝে থাকে লাইসোজাইম। লাইসোজাইম একপ্রকার এনজাইম। এই এনজাইমটি ব্যাকটেরিয়ার কোষ প্রাচীরের কাঠামোগত দৃঢ়তা বা স্ট্রাকচারাল ইন্টেগ্রিটি নষ্ট করে। ঘামে থাকে এমোনিয়া। এমোনিয়ারও ব্যাকটেরিয়া বিরোধী গুণাগুণ আছে। এছাড়াও একাধিক জীবাণুবিরোধী পেপটাইড থাকে ঘামে , যেমন ডিফেন্সিন।

মিউকাস মেমব্রেন: একইভাবে, রেসপিরেটরী বা শ্বাসতন্ত্র, গ্যাস্ট্রোইন্টেসটিনাল বা পরিপাকতন্ত্র, জেনিটোইউরিনারী ট্র্যাক্ট বা মূত্রনালীর মিউকাস মেমব্রেনও বিভিন্ন প্রকার সংক্রমনের বিরুদ্ধে একটি ফিজিকাল ব্যারিয়ার প্রদান করে। মিউকাস মেমব্রেন থেকে মিউকাস ( এক প্রকাশ পিচ্ছিল জৈবিক পদার্থ) নিঃসরণ হয়। আক্রমণশীল বা ইনভেডিং প্যাথোজন এই মিউকাসের মাঝে আটকা পড়ে যায়। ওদিকে এ্যাডাপ্টিভ ইমিউন সিস্টেম থেকে সৃষ্টি হয় ইমিউনোগ্লোবিউলিন-এ বা আইজি-এ। এই আইজি-এ ব্যকটেরিয়া বা ভাইরাসে এপিথেলিয়াল সেলের সাথে যুক্ত হতে বা প্রবেশ করতে বাঁধা দেয়। ত্বকের মত , মিউকোযাল মেমব্রেনেও থাকে লাইসোযাইম এবং এ্যন্টিমাইক্রোবিয়াল পেপটাইড। এরা সরাসরি আক্রমণাত্নক প্যাথোজেনকে ধ্বংস করে। আর অন্যদিকে ল্যাক্টোফেরিন ব্যাক্টেরিয়ার আয়রন গ্রহণ করতে দেয় না।

শ্বাসতন্ত্রের সিলিয়া: রিসপেরিটোরী ট্র্যাক্টে বা শ্বাসতন্ত্রে চুলে বা ব্রাশের অনুরূপ গঠণের কিছু কোষ থাকে। এটিই সিলিয়া।

 


সিলিয়া সরাসরি রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বা ঐধরণের বাহ্যিক ক্ষতিকর বস্তুকে আটকে দেয়। মিউকাস অপসারণেও সিলিয়া ভূমিকা রাখে। হাঁচি, কাশির মাধ্যমে শরীর থেকে বের দেওয়া হয় রোগ সৃষ্টিতে সক্ষম পদার্থকে।

পরিপাক তন্ত্রের পরিবেশ: গ্যাস্ট্রোইন্টেসটিনাল ট্র্যাক্টে, রাসায়নিক ভাবে ব্যাক্টেরিয়াকে ধ্বংস করে হাইড্রেক্লোরিক এসিড এবং স্যালাইভারি এ্যামাইলেয। অন্যদিকে , সাধারণ পেরিস্টালসিস বা মলত্যাগের বেগ, এবং ইনডিউস্ড বা সৃষ্ট ডায়রিয়া এবং বমি - আক্রমণাত্নক জীবাণু শরীর থেকে নিষ্কাশনে সাহায্য করে।

দেহে বসবাসকারী কল্যাণকর জীবাণু :  ‘দি মাইক্রোবায়োম’, যেটি এন্ডোজেনাস কমেনসাল ব্যাক্টেরিয়া বা দেহের সাথে সৌহার্দ্য বজায় রেখে আমাদের ভেতর বাস করে এরকম জীবাণু নিয়ে গঠিত। এরা বিভিন্ন প্রকার সংক্রমণের বিরুদ্ধে একটি বাড়তি সুরক্ষা প্রদান করে। অনুমান করা হয়, ১০ টু দি পাওয়ার ১৪, পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া মানবদেহের এপিথেলিয়াল সারফেসে বাস করে, যারা দেহের ক্ষতি করে না, উল্টো সুরক্ষা প্রদান করে ( সিম্বায়োসিস)। এসব ব্যাকটেরিয়া জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলির জন্য, অন্যান্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার সাথে প্রতিযোগিতা করে। যেমন স্থান, পুষ্টি ইত্যাদি। এবং তারা প্রস্তুত করে ফ্যাটি এসিড ও ব্যাক্টেরিসিডিন। ব্যাক্টেরিসিডিন , বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর বৃদ্ধি ব্যাহত করে। পাশাপাশি, সাম্প্রতিক গবেষনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস লক্ষ্য করা যায়। যে, কমেনসাল ব্যাকটরিয়া, ইন্টেসটিনে নির্দিষ্ট রেগুলেটোরী টি সেল ইনডাকশানে ভূমিকা রাখে। ব্রড-স্পেকট্রাম এ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্চ ব্যাবহার মাধ্যমে এই নর্মান ফ্লোরা বা উপকারী ব্যাক্টেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণতঃ অপুর্চুনিস্টিক ইনফেকশান দেখা যায়। যেমন - ক্লস্ট্রিডিয়াম ডিফিসিল। একটি প্রতিযোগিতাহীন , সুরক্ষাহীন পরিবেশ পেলেই দ্রুত সেখানে সংখ্যাবৃদ্ধি করে ক্লস্ট্রিডিয়াম।

  

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে করণীয়

 

উপরোক্ত আলোচনা সাপেক্ষে বোঝা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট কিছু বিষয় মেনে চললে, আমরা সহজেই বিভিন্ন প্রকার রোগ ব্যাধি প্রতিরোধে সফল হতে পারি।

ত্বকের দৃঢ়তা বজায় রাখা : ত্বকের দৃঢ়তা ও স্বাভাবিক সৌষ্ঠব রক্ষা করার গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় বয়সের সাথে আমাদের ত্বক তার স্বাভাবিক দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলে। অনেক ছোটখাট রোগব্যাধি এজন্য প্রকট রূপ নেয় বৃদ্ধ বয়সে। নিয়মিত ব্যায়াম, ম্যাসাজ, ফলমূল শাকসবজি জাতীয় খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ এবং পরিমিত মাত্রায় প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ আমাদের ত্বককে মজবুত রাখতে পারে।



ত্বককে শুষ্কতা থেকে রক্ষা করুন : ত্বকের স্বাভাবিক তৈলাক্ততা রক্ষা করা রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে শীতকালে ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে ওঠে। ত্বক তার তৈলাক্ততা হারিয়ে ফেললে নানান ধরণের চর্মরোগের উপযোগী ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। ভালোভাবে ত্বক পরিষ্কার করে, জেলি বা ক্রিম প্রয়োগের মাধ্যমে ত্বকের স্বাভাবিক তৈলাক্ততা বজায় রাখা যেতে পারে

ধূমপান ত্যাগ : শ্বাসতন্ত্রের সিলিয়াকে ধ্বংস করে দেয় ধূমপানের অভ্যাস। সিগারেট, বিড়ি ইত্যাদির বিষাক্ত ধোঁয়ার আমাদের শরীরের আভ্যন্তরীণ মিউকাস মেমব্রেনগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ধূমপানের অভ্যাস থাকলে সিলিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়, এবং সিলিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হলে শ্বাসতন্ত্রের নানান ধরণের সংক্রমণের সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ক্রনিক ধূমপায়ীরা প্রায় সারা বছরই কাশিসহ শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য রোগে ভুগে থাকেন, যার শেষ পরিণতি ফুসফুসের বিভিন্ন জটিল ও নিরাময়ের অযোগ্য রোগ।

নিয়মিত ব্যায়াম করুন বা হাঁটুন : নিয়মিত ব্যায়াম শরীরে রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে। ব্যায়ামের ফলে ত্বকের নীচে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। ঘাম হয়। শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন অংশও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। রোগ প্রতিরোধে ব্যায়ামের গুরুত্ব নিয়ে পৃথক ও বিশদ আলোচনা জরুরী।



মানসিক চাপ পরিহার করুন: মানসিক চাপ শরীরের স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধে জরুরী কোষগুলির ওপরও একটি দমনমূলক প্রভাব ফেলে মানসিক চাপ। শরীর সুস্থ রাখার জন্য মানসিক চাপ পরিহার করা জরুরী।‌

এ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যাবহার থেকে বেঁচে থাকুন :  এ্যান্টিবায়োটিকের কাজ জীবাণু ধ্বংস করা। যেকারণে কড়া মাত্রার এ্যান্টিবায়োটিকে আমাদের পরিপাকতন্ত্রে বসবাসকারী উপকারী কমেনসাল-ব্যাক্টেরিয়াও ধ্বংস হয়ে যায়। সাধারণ ভাইরাস ঘটিত সর্দি-জ্বরেও আমাদের দেশে এ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার ধূম পড়ে যায়। এ্যান্টিবায়োটিকের ফলে ভাইরাসের যেহেতু কিছুই হয় না, সুতরাং সর্দি-জ্বরের কোন উপশম হয় না এ্যান্টিবায়োটিকে। কিন্তু পাকস্থলীর উপকারী ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংস হয়ে যায় নানান ধরণের রোগের ঝুঁকিতে পড়ে যাই আমরা।

 

দেহের স্বাভাবিক ও প্রারম্ভিক রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থাগুলোর যত্ন নিলে, ও সাধারণ কিছু বিষয় খেয়াল রাখলে ও মেনে চললেই আমরা খুব সহজেই বিভিন্ন অসুস্থতা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারি। সুস্থ সুন্দর জীবনের কামনা সবার জন্য। 

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

লেখক পরিচিতি 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নিউরোলজির বিভিন্ন পরীক্ষা নীরিক্ষা

  লোকালাইজিং   লেশান্স   ইন দি সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম - ( সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে ক্ষত বা লেশানের অবস্থান নির্ণয় )   রোগীর হিস্ট্রি নি...