শীতের সময়টাই জ্বর-সর্দি-কাশির। সাধারণতঃ ভাইরাস ঘটিত জ্বর বা ভাইরাল ফিভার পাঁচ দিনের মাঝেই সেরে যায়। করোনা ভাইরাসের জ্বরও পাঁচ দিনের বেশী থাকে না। তবে জ্বরের সময়কাল এর চেয়ে দীর্ঘ হলেই নানান ধরণের জটিলতা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া এক সপ্তাহ’র অধিক জ্বর, জ্বরের সাথে অন্যান্য উপসর্গ থাকার অর্থ সাধারণ ভাইরাসের চেয়েও বিপদজনক কোন কারণ হয়তো বিদ্যমান। জ্বর বিষয়ে কিছু সাধারণ তথ্য জেনে রাখা যায়। কারণ, রোগী নিজের রোগ সমন্ধে যত স্পষ্ট ধারণা রাখেন, তার চিকিৎসা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনাও ততই বাড়ে।
জ্বর কি ?
জ্বর কেন হয়?
আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থার (immune system) সাধারণ ধর্ম হল শরীরে কোন জীবাণু প্রবেশ করলে তাকে ধ্বংসের জন্য বিশেষায়িত কোষ পাঠায়। জীবাণু বা যেকোন ফরেন-বডি বিধ্বংসী এই কোষকে বলে ‘সাইটোকাইন’ (cytokine)। আবার শরীরের আঘাতপ্রাপ্ত হলে বা অন্য কোন প্রকার Traumaর সম্মুখীন তৈরী হলে লিভার থেকে কিছু বিশেষ ধরণের প্রোটিণ নিঃসরণ হয়। এই প্রোটিনের নাম ‘ একিউট ফেয প্রোটিন ’
এই সাইটোকাইনের এবং একিউট ফেয প্রোটিনের (acute phase proteins) সক্রিয়তা দেহের আভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। ফলে জ্বর হয়।
জীবাণু সংক্রমণ বা সংক্রমণ ব্যাতীত দু’ভাবেই জ্বর হতে পারে।
জ্বর হলে আপনার চিকিৎসক আপনাকে যেসব পরীক্ষা করতে দিতে পারেন
সাধারণ জ্বর মাথাব্যাথায় যে প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ খেয়ে নিলেই উপকার পাওয়া যায়, সেটা আমাদের সবারই কম বেশী জানা। প্যারাসিটামল খাওয়ারও প্রয়োজন সবসময় হয় না। পর্যাপ্ত বিশ্রামই যথেষ্ট হয়।
এধরণের পরিস্থিতিতে চিকিৎসক তার পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে আপনাকে এই প্রাথমিক পরীক্ষাগুলো করার প্রস্তাব দিতে পারেন :
১। থ্রোট সোয়াব (Throat swab) বা ন্যাসাল সোয়াব (Nasal swab) সংগ্রহপূর্বক কালচার অথবা পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশান (PCR) :
করোনাকালের প্রথমদিকে ‘থ্রোট সোয়াব’ এবং পরবর্তীতে ও বর্তমানে ‘ন্যাসাল সোয়াবের’ কথা প্রায় মানুষ শুনেছেন। যারা করোনা পরীক্ষা করিয়েছেন তারা জানেন ন্যাসাল সোয়াব কি। লম্বা একটি কটনবাড দিয়ে আপনার ন্যাসাল বা নাসিকা গহ্বর থেকে ন্যসাল মিউকোসা বা নাসিকা গাত্রের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এই নমুনা বিশ্লেষণ করেই জীবাণুর উপস্থিতি নির্ণয় করা হয়।
পলিমারেজ চেইন রিএকশান বা পিসিআরে একটি সংগ্রহীত ভাইরাল নমুনার ডিএনএকে কয়েকগুণ বিবর্ধিত করা হয়। ‘ডিনেটারেশান’ নামক প্রক্রিয়ায় ( মূলতঃ ধারাবাহিক রূপে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করা ও কমানো) একটি ডিএনএ’র ডবল স্ট্র্যান্ডকে ভেঙে দু্’টি স্ট্র্যান্ড তৈরী করা হয়। তারপর ঐ স্ট্র্যান্ডকে টেমপ্লেট হিসেবে ব্যাবহার করে মূল ডিএনএর বিবর্ধিত প্রতিলিপি তৈরী করা হয়। সেই বিবর্ধিত প্রতিলিপিটিই জানিয়ে দেয় কোন জীবাণু দিয়ে রোগ হয়েছে
* প্রোটকল অনুযায়ী এই পরীক্ষাটি শেষে উল্লেখ করার কথা। তবে বর্তমান করোনা পরিস্থিতির সাপেক্ষে এটি সবার আগে লেখা হল।
২। রক্ত পরীক্ষা ( full blood count (FBC) with differential, including eosinophil count)
রক্তের লোহিত ও শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ জানা যায় এই পরীক্ষা থেকে। নির্দিষ্ট সংক্রমণ সাপেক্ষে এই রক্তকোষগুলোর পরিমাণে নানান তারতম্য ঘটে। এই চিত্রটি পাওয়ার জন্যই এই পরীক্ষা করা হয়।
৩। ইউরিয়া এবং ইলেকট্রোলাইট (urea and electrolytes)
শরীরের বিপাকীয় কর্মকান্ড সমন্ধে ধারণা পাওয়া যায় এই পরীক্ষা থেকে। রক্তের সোডিয়াম, পটাশিয়ামের মাত্রা ঠিক আছে কি না দেখার জন্য ইলেকট্রোলাইট পরীক্ষা করা হয়।
৪। লিভার ফাংশান টেস্ট , ব্লাড গ্লুকোজ এবং মাসেল এনজাইম ( liver function tests (LFTs), blood glucose and muscle enzymes )
লিভার বা যকৃতের অবস্থা জানা যায় লিভার ফাংশান টেস্টে। লিভার যে এনজাইম, প্রোটিন ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থ তৈরী করে সেগুলি সঠিক মাত্রায় রয়েছে কি না তা জানার জন্য করা হয় এই পরীক্ষা।
শরীরে সংক্রমণের অস্তিত্ব থাকলে কর্টিসোল ও এড্রেনালিন হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। এই হরমোনগুলো ইনসুলিনের ক্রিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে। তখন বেড়ে যায় ব্লাড-গ্লুকোজ লেভেল।
ট্রমার বা আঘাতের ফলে পেশী ক্ষতিগ্রস্থ হলে মাসেল-এনজাইম যেমন: ক্রিয়েটিন কাইনেয বৃদ্ধি পায়। ট্রমা বা আঘাত জ্বরের কারণ কি না সেটি নির্ণয়ের জন্য এই পরীক্ষা করা হয়।
৫। ইনফ্লামেটরী মার্কার্স, এরিথ্রোসাইট সেডিমেন্টেশান রেট, সি-রিয়েকটিভ প্রোটিন (inflammatory markers, erythrocyte sedimentation rate (ESR) and C-reactive protein (CRP) ) :
শরীরে প্রদাহের উপস্থিতি থাকলে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরিত হয়। এগুলিই ইনফ্লামেটোরী মার্কার্স। সি-রিয়েকটিভ প্রোটিন লিভারে তৈরী হয়। এর সাধারণ মাত্রা প্রতি লিটারে ১০ মিগ্রা’র কম। এর বেশী থাকা মানেই গুরুতর সংক্রমণ ও প্রদাহ বিদ্যমান।
ইএসআর এর সাধারণ মান নারীদের ০-১৫ মিমি-প্রথম ঘন্টায় এবং পুরুষদের জন্য ০-২০ মিমি-প্রথম ঘন্টায়। এর বেশী থাকার অর্থ সংক্রমণ রয়েছে।
৬। এইচ-আই-ভি ওয়ান ভাইরাসের এন্টিবডি নির্ণয়ের পরীক্ষা :
রোগীর যদি একাধিক যৌনসঙ্গী, সিরিঞ্জে মাদক গ্রহণের ইতিহাস পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে এই পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যকর্মীরাও অনেক সময় নিডল-স্টিক ইনজুরির মাধ্যমে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। সেজন্য তাদের জন্যও এই পরীক্ষা দিতে পারেন চিকিৎসক।
৭। ইউরিন এ্যনালাইসিস এবং ইউরিন কালচার ( urinalysis and urine culture ) :
মূত্র বিশ্লেষণ করে প্রোটিনের পরিমাণ, সুগারের পরিমাণ, রক্তকণিকা, বিভিন্ন কোষের উপস্থিতি, মূ্ত্রের রঙ, ঘনত্ব ইত্যাদি নির্ণয় করাকেই ইউরিন এ্যানালাইসিস বলে। এর মাধ্যমে সংক্রমণের প্রকৃতি সমন্ধে ধারণা পাওয়া
মূ্ত্রে কোন নির্দিষ্ট জীবাণুর উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য ইউরিন কালচার করা হয়।
৮। চেস্ট-এক্স-রে এবং ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম ( chest X-ray and electrocardiogram (ECG) ):
চেস্ট-এক্স-রে (chest X-ray) বা বুকের এক্স-রে করে ফুসফুসের বর্তমান অবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। করোনা, যক্ষা, নিউমোনিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন রোগে নির্দিষ্ট ধরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় বুকের এক্স-রে তে। এই পরিবর্তনের সাপেক্ষেই নির্ণয় করা হয় রোগ।
ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম বা ইসিজির (ECG) মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের অবস্থা সমন্ধে ধারণা পান চিকিৎসক। হৃৎযন্ত্রের সংক্রমণ যেমন ইনফেকটিভ এন্ডোকার্ডাইটিসে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় ইসিজিতে।
৯। ব্লাড কালচার ( blood culture):
ব্লাড কালচারে (Blood Culture) ক্ষেত্রে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহীত নমুনাকে ‘কালচার’ করা হয়। ফলে নমুনায় কোন জীবাণু থাকলে সেটি সংখ্যায় ও নিজ বৈশিষ্ট্যে বিবর্ধিত হয়। নমুনাটি থেকে তখন নির্ণয় করা যায় রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু।
১০। রোগীর ইতিহাস এবং চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে অন্যান্য নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করতে হতে পারে। যেমন
- শরীরের ক্ষত-স্থান থাকলে ‘ উন্ড সোয়াব’ বা ক্ষতস্থান থেকে সোয়াব নিয়ে পরীক্ষা।
- বহুদিন ধরে কাশি থাকলে কফ পরীক্ষা বা স্পুটাম পরীক্ষা
- স্টুল কালচার বা পায়খানার নমুনা পরীক্ষা। ওভা (পরজীবীর ডিম্বাণু) এবং পরজীবী নির্ণয়ের জন্য মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষা।
- এবং ‘ক্লিস্ট্রিডিয়াম ডিফিসিল টক্সিন এস্যে’ : ডায়রিয়া ও মলাশয়ের প্রদাহের জন্য দায়ী জীবাণু নির্ণয়ের জন্য এই পরীক্ষা করা হয়।
১১। ভৌগলিক অবস্থানের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষা করা হয়। যেমন
- ম্যালেরিয়া নির্ণযের পরপর তিনদিন রক্তের নমুনা সংগ্রহ ও স্লাইড প্রস্তুতকরণ বা ম্যালেরিয়া রেপিড ডায়গনোস্টিক টেস্ট।
- ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে এন-এস-ওয়ান এন্টিজেন ( এন্টিজেন ডিটেকশান)।
- ‘সালমোনেলা টাইফি’ - পেটের পীড়া সৃষ্টিকারী জীবাণুর জন্য ব্লাড কালচার । সাথে পেটের আল্ট্রাসাউন্ড।
জ্বর হলে কি করবেন?
- জ্বর এবং তার সাথের অন্যান্য সাধারণ উপসর্গ যেমন মাথা ব্যাথা, শরীর ব্যাথা এগুলি প্যারাসিটামোল সেবনেই উপশম হতে পারে
- শরীরের তাপমাত্রা কমানোর জন্য ভেজা ন্যাকড়া বা গামছা দিয়ে শরীর মুছিয়ে দেয়া যায়
- জ্বরের রোগীরা প্রচুর ঘামেন অনেক সময়। এধরণের রোগীদের ক্ষেত্রে লবণ এবং পানীয়ের অভাব পূরণ করা খুবই জরুরী
- এছাড়া উপরোক্ত পরীক্ষা নীরিক্ষা করে জ্বরের অন্তর্নিহিত অন্য যে কারণ পাওয়া যাবে , তদানুযায়ী বাকী চিকিৎসা করতে হবে।
সুস্থ থাকুন। নিজের যত্ন নিন।
--------------------------------
সূত্র: ডেভিডসন্স মেডিসিন ২৩ তম সংস্করণ ও লেখকের চিকিৎসাপেশায় অভিজ্ঞতা















কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন