মঙ্গলবার, ৪ মে, ২০২১

কোভিড-১৯ চিকিৎসায় রেমডেসিভির : কিভাবে কাজ করে এবং আসলেই কতটা কার্যকর এই এন্টিভাইরাল ?

 কোভিড-১৯ এর চিকিৎসাগুলোর মধ্যে রেমডেসিভির এর নাম সবচেয়ে বেশী শোনা যায় ইদানীং। করোনার আগ্রাসন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে - এমন দেশগুলোতে, এক ভায়াল রেমডেসিভির যোগাঢ় করতে মানুষ কি করছেন, কি ধরণের হেনস্থার স্বীকার হচ্ছেন সেসবের হৃদয়বিদারক গল্প ইন্টারনেটে ভেসে বেড়াচ্ছে। বিকল্প পথে রেমডেসিভির যোগাঢ় করতে গিয়ে অনেকেই বিপুল পরিমাণ টাকা পয়সাও খরচ করে ফেলছেন।

কিন্তু আসলেই কি রেমডিসিভির কোন মহৌষধ? রেমডেসিভির (Remdesivir) জিনিসটা আসলে কি? শোনা-কথা ও কল্প-কাহিনী নয়,বরঙ তথ্য ও বিজ্ঞানের ভিত্তিতে বিবেচনা করুন। এই লেখায় আমরা রেমডেসিভির বিষয়ে কিছু বাস্তব ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। 

করোনা ভাইরাস থেকে সেরে ওঠার পর কিভাবে জীবনযাপন করবেন -জানতে পড়ুন

রেমডেসিভির কি ? 

রেমডেসিভির (Remdesivir) একটি নিউক্লিওটাইড ড্রাগ। অর্থাৎ, ডিএনএ-আরএনএর গাঠনিক অণু থেকে ড্রাগটি তৈরী করা হয়। রেমডেসিভির  একটি প্রোড্রাগ : শরীরে প্রবেশের পর ড্রাগটি সরাসরি কাজ করে না। প্রাথমিক একটি বিপাকীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়। বিপাকলব্ধ রূপটিই শরীরে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে। রেমডেসিভির একটি ইন্ট্রাভেনাস ড্রাগ। অর্থাৎ, শিরাপথে প্রয়োগ করা হয় এই ঔষধটি।

করোনা চিকিৎসায় রেমডেসিভির

রেমডেসিভির কিভাবে কাজ করে?

করোনা ভাইরাস বা যেকোন আর-এন-এ ভাইরাসের আর-এন-এ’ চারটি উপাদান নিয়ে গঠিত হয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘এডোনোসিন’। রেমডেসিভির এই এডেনোসিনের এনালগ। অর্থাৎ এডেনোসিনের অনুরূপ একটি আণবিক কাঠামো। রেমসডেসিভির ভাইরাসের আর-এন-এ নির্ভর আর-এন-এ পলিমারেজের সাথে যুক্ত হয়। ড্রাগটির যুক্ত হওয়ার ফলে ভাইরাসের আর-এন-এ ট্রান্সক্রিপশান বা ভাইরাল আর-এন-এ’র অনুলিপি তৈরী হওয়ার ঘটনাটি সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। ফলে, করোনা ভাইরাসটি আর সংখ্যায় বিভাজিত হতে পারে না। অর্থাৎ, শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণটি রুদ্ধ হয়।

পরীক্ষাগারে, রেমডেসিভির , সার্স- করোনা ভাইরাস -২ এর বিরুদ্ধে সক্রিয়তা দেখাতে পেরেছে। মানুষের অনুরূপ অসংখ্য বৈশিষ্ট্য দেখা যায় ‘রেসাস ম্যাক’ প্রজাতির বানরের ভেতর। এই বানরগুলোতে প্রথমে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ঘটিয়ে, পরবর্তীতে রেমডেসিভিরের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। দেখা গেছে, রেমডেসিভির পেয়েছে যে বানরগুলো, তাদের শরীরে ভাইরাসের মাত্রা, এবং ফুসফুসের ক্ষতি, অন্য সাধারণ ( রেমডেসিভির পায়নি যেসব বানর) প্রাণীগুলোর তুলনায় কম।

করোনায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক মক্সিফ্লক্সাসিন কিভাবে কাজ করে- জানতে পড়ুন

কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় রেমডেসিভির অনুমোদন :

এফডিএ বা ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনস্ট্রেশান কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য রেমডেসিভির ব্যবহারের অনুমোদন দেয় ২০২০ সালের অক্টোবার মাসের ২২ তারিখ। কোভিড-১৯ এর কারণে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছেন, এরকম প্রাপ্ত বয়স্ক এবং শিশু (যাদের বয়স বারো বছরের বেশী, এবং ওজন ৪০ কেজির উর্ধ্বে)-দের চিকিৎসায় রেমডেসিভির ব্যবহার করা হয়। এফডিএর একটি “ এমার্জেনসী ইউজ অথোরাইজেশান” বা জরুরী অবস্থা সাপেক্ষে অনুমোদনের বদৌলতে আরে কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেও ( যাদের ওজন ৩.৫ কেজি থেকে চল্লিশ কেজির কম অথবা বয়স ১২ বছরের কম এবং ওজন ৩.৫ কেজির বেশী ) ব্যবহার করা যেতে পারে।

রেমডেসিভির ড্রাগটি অবশ্যই একটি হাসপাতালের ভেতরে ব্যবহার করতে হবে। হাসপাতাল সম্ভব না হলে, হাসপাতালের নূন্যতম সেবা-ব্যবস্থা সম্পন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। এটি একটি যথেষ্ট কড়া ঔষধ। বাড়িতে ব্যবহার করার সুযোগ নেই। 

রেমডেসিভিরের ডোজ :

চিকিৎসা শুরুর প্রথম দিন, কোভিড-১৯ এর জন্য, শিরাপথে ২০০ মিগ্রা রেমডেসিভির দেয়া হয়, । দ্বীতিয় দিন থেকে ১০০ মিগ্রা প্রতিদিন দেয়া হয়। এভাবে সাধারণতঃ দশ দিন পর্যন্ত চিকিৎসাটি চলতে থাকে। পুরো ঔষধটি ৩০ থেকে ৬০ মিনিটের ভেতরে দিয়ে শেষ করা হয়।

কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় রেমডেসিভিরের কার্যকারিতা নিয়ে বেশ অনকগুলি ক্লিনিকাল ট্রায়াল পরিচালনা করা হয়েছে বিশ্বজুড়ে। করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় এই এন্টিভাইরালটি যে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি এই ট্রায়ালগুলোর ওপর ভরসা করেই। কর্টিকোস্টেরয়েডস এবং রেমডেসিভির একসাথে ব্যবহার করলে কতটুকু উপকার পাওয়া যাবে, এবং এধরণের ব্যবহার কতটুকু নিরাপদ সেটি কিন্তু এসব ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলোতে খুব ভালভাবে গবেষণা করা হয়নি। যদিও তাত্ত্বিক বিবেচনায় বলা হয় যে, কোভিড-১৯ গুরুতর রূপ ধারণ করেছে এমন রোগীদের ক্ষেত্রে স্টেরয়েড এবং এই এন্টিভাইরালটি একসাথে দেয়ার কিছু উপকার রয়েছে।

ঔষধ কিভাবে কাজ করে আমাদের শরীরে ? জানতে পড়ুন

রেমডেসিভিরের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া : 

রেমডেসিভির (Remdesivir) পাচ্ছেন, এমন রোগীদের পরিপাকতন্ত্রের বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন - বমি ভাব। এই ড্রাগটিকে বিপাক করতে গিয়ে লিভারের ওপর চাপ পড়ে। ফলে, ট্রান্সএমাইনেজ লেভেল বেড়ে যায়। প্রোথ্রোম্বিন টাইম স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী হতে পারে। সেই সাথে বিভিন্ন ধরণের হাইপার সেনসিটিভিটি  বা এলার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে রোগী।

রেমডেসিভির প্রয়োগ করার আগে সমস্ত রোগীর লিভার ফাংশান টেস্ট এবং প্রোথ্রোম্বিন টাইম দেখে নিতে হবে। চিকিৎসা চলাকালীন সময়েও এই দুটো জিনিসের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যদি দেখা যায়, লিভারের এনজাইম - এলানাইন ট্রান্সএমাইনেজ বা এ-এল-টি তার স্বাভাবিক সর্বোচ্চ পরিমাণের চেয়ে ১০ গুণ বেশী বেড়ে গেছে, এবং সাথে লিভারের প্রদাহজনিত উপসর্গ থাকে রোগীর সেক্ষেত্রে রেমডিসিভির বন্ধ করতে হতে পারে।

কিডনীতে দুর্বলতা রয়েছে এমন রোগীদের ক্ষেত্রে রেমডিসিভির প্রয়োগ : 

রেমডেসিভির পাওয়া যায় ‘লাইপোফিলাইজড পাওডার’ হিসেবে। লাইপোফিলাইজড পাওয়ডার অর্থ, শীতলকরণের মাধ্যমে পানি শুকিয়ে যেই পাওডার তৈরী করা হয়েছে। এরকম প্রতিটি ১০০ মিগ্রা রেমডেসিভির পাওডারের ভায়ালে ‘সালফোবিউটাইল ইথার বিটা-সাইক্লোসডেক্সট্রিন সোডিয়াম’ (এস-বি-ই-সি-ডি) দেয়া থাকে ৩ গ্রাম। অন্যদিকে ১০০ মিগ্রা পার ২০ মিলি ভায়ালের রেমডেসিভির সলিউশনে ৬ গ্রাম করে এস-বি-ই-সি-ডি থাকে। এস-বি-ই-সি-ডি রেমডেসিভির ড্রাগটির জন্য একটি বাহনের মত। সাধারণতঃ কিডনীর মাধ্যমে এই পদার্থটিকে শরীর থেকে বের করে দেওয়া হয়।

এখন, কোভিড-১৯  আক্রান্ত যে রোগীটি রেমডেসিভিরের ২০০ গ্রাম লোডিং-ডোজ পাবেন প্রথম দিন, তার ক্ষেত্রে একসাথে ৬ থেকে ১২ গ্রাম এস-বি-ই-সি-ডি শরীরে প্রবেশ করছে। যাদের কিডনী সুস্থ তাদের ক্ষেত্রে ৬ থেকে ১২ গ্রাম এস-বি-ই-সি-ডি সাধারণতঃ কোন সমস্যা করে না। কিন্তু আগে থেকে কিডনী জটিলতায় ভুগছেন এমন রোগীর ক্ষেত্রে এই পদার্থটি শরীর থেকে বের হতে পারে না। শরীরে জমে গিয়ে এস-বি-ই-সি-ডি তখন বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে লিভার এবং কিডনী।

তাই, যেসব রোগীর কিডনী জটিলতা আছে তাদের ক্ষেত্রে সলিউশানের বদলে পাউডারটিই সাধারণতঃ ব্যবহার করে থাকেন ডাক্তাররা। কারণে পাউডারে, এস-বি-ই-সি-ডি কম থাকে।

যেহেতু, রেমডেসিভিরের ফর্মুলেশানগুলোতে এই এস-বি-ই-সি-ডি থাকে, তাই যেসব রোগীর আনুমানিক গ্লোমেরুলার ফিলট্রেশান রেট মিনিটে ৫০ মিলিলিটারের কম, অনেক  ক্লিনিকাল ট্রায়ালে তাদের ওপর ড্রাগটি প্রয়োগই করা হয়নি। জিএফআর মিনিটে ৩০ মিলিলিটারের কম এমন রোগীদের ক্ষেত্রে রেমডেসিভির ব্যবহার করা যাবে না। রেমডেসিভির দিয়ে চিকিৎসার সময়ও, রেনাল ফাংশানের দিকে সার্বক্ষনিক মনযোগ দেয়া প্রয়োজন।

রেমডেসিভিরের সাথে অন্য ঔষধের মিথস্ক্রিয়া : 

রেমডেসিভিরের সাথে অন্য ড্রাগের আন্তঃক্রিয়া বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও বিশদ গবেষণা এখনও তেমন নেই। গবেষণাগারগুলোতে যতটুকু দেখা গেছে, যে, সাইটোক্রোম পি৪৫০ এনজাইম এবং ড্রাগ ট্রান্সপোর্টার অর্গানিক অ্যানায়ন ট্রান্সপোর্টিং পলিপেপটাইড ওয়ান-বি-ওয়ান ও পি-গ্লাইকোপ্রোটিনের একটি অবশিষ্টাংশ হচ্ছে - রেমডিসিভির।

রেমডেসিভির , ডেক্সামিথাসোনের সাথে ব্যবহার করলে এন্টিভাইরালটির কার্যকারিতায় কোন সমস্যা লক্ষ্য় করা যায় নি। রেমডেসিভিরের সাথে ক্লোরোকুইন, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহার করলে ঔষধটির এন্টিভাইরাল অ্যাকশানটিকে কমিয়ে দিতে পারে। তাই এসব ড্রাগগুলি একসাথে ব্যবহার করা হয় না।  ওসেল্টামিভির বা ব্যালোক্সাভির এর সাথে রেমডেসিভির ব্যবহার করলে , ড্রাগ দুটোর কোনটাই একে অন্যের ওপর ভালো-মন্দ কোন ধরণের প্রভাবই ফেলে না।  

বিভিন্ন ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলোর পূর্ণ হদিস পেতে এই লিংকে যেতে পারেন

গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে রেমডেসিভিরের ব্যবহার  :

- কোভিড-১৯ চিকিৎসায় রেমডেসিভির ব্যবহার নিয়ে যেসব ক্লিনিকাল ট্রায়াল পরিচালনা করা হয়েছে সেখানে গর্ভবতী রোগীদের রাখা হয়নি। তবে বিভিন্ন হাসপাতালে, করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী রোগীদের ওপর রেমডেসিভির ব্যবহার করে ভাল ফলাফল পাওয়া গেছে।

-  গর্ভবতী এবং সদ্য মা হয়েছেন, এমন ৮৬ জন হাসাপাতালে অবস্থানরত কোভিড-১৯ রোগীর ওপর রেমডেসিভির ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি।

- অন্য কোন সমস্যা না থাকলে, একজন গর্ভবতী কোভিড-১৯ রোগীকে রেমডেসিভির দিয়ে চিকিৎসা করা যেতে পারে।

শিশুদের ক্ষেত্রে রেমডেসিভিরের ব্যবহার :

- ১২ বছর বয়সের কম, অথবা ৪০ কেজির নীচে ওজন এরকম শিশুদের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় রেমডেসিভিরের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিয়ে তেমন কোন গবেষণা করা হয় নি।

- এফডিএর বিশেষ অনুমোদন সাপেক্ষে হাসাপতালে চিকিৎসাধীন গুরুতর রূপে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত শিশু রোগী যাদের ওজন চল্লিশ কেজির কম কিন্তু সাড়ে তিন কেজির বেশী, এবং যাদের বয়স বারো বছরের কম , এবং ওজন সাড়ে তিন কেজির বেশী, তাদের জন্য রেমডেসিভির ব্যবহার করা যেতে পারে।

কোভিড-১৯ চিকিৎসায় রেমডেসিভির (Remdesivir) এন্টিভাইরালটি একটি কার্যকরী ঔষধ, কিন্তু জাদুকরী কোন চিকিৎসা নয়। যেহেতু করোনা চিকিৎসার জন্য় এফডিএ'র অনুমোদন পাওয়া এন্টিভাইরাল ড্রাগগুলোর মধ্যে এটিই সর্বপ্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র, তাই রেমডেসিভির করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা হিসেবে প্রচার পেয়েছে অনেক বেশী। রেমডেসিভির ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসক ও হাসপাতালের শরাপন্ন হবেন। বিকল্প পথে ড্রাগটি যোগাঢ় করে, নিজে নিজে বাসায় ইনজেকশান পুশ করলে সেটি হবে নির্বুদ্ধিতা এবং ফলাফল হিতে বিপরীত হতে পারে। 

মহামারিতে এই এন্টিভাইরালের ব্যবহার নিয়ে আরও জানতে পড়ুন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নিউরোলজির বিভিন্ন পরীক্ষা নীরিক্ষা

  লোকালাইজিং   লেশান্স   ইন দি সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম - ( সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে ক্ষত বা লেশানের অবস্থান নির্ণয় )   রোগীর হিস্ট্রি নি...